গলায় জমে থাকা পাথরের মতো কিছু

রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে ঘড়ির কাঁটার চেয়ে বেশি শব্দ হয় চুপ করে থাকা জিনিসগুলোর। যেমন, জানালার পাল্লায় ধুলো। যেমন, দরজার ফাঁকে ঢুকে পড়া বাতাসের ঠাণ্ডা কান্না। যেমন, বুকের ঠিক মাঝখানে জমে থাকা একটা অজানা পাথর, যে পাথর কোনো কবরে পড়ে নেই, আবার কোনো পাহাড়েও ওঠে না। শুধু গলায় আটকে থাকে, কথা বলে না।

আমি জানতে চাই, এই যে প্রতিদিন ঘুম ভাঙার আগে একটুখানি মৃত্যু হয়, তার পরে আবার নতুন করে শুরু হয় কেন? পৃথিবীর এত মানুষের মুখে এত কথা—কিছুই শেষ হয় না, কিছুই শুরু হয় না, শুধু একইরকম ঘূর্ণি। এক কাপ চায়ের ভাপের মধ্যে ক’জন মানুষের ভবিষ্যৎ ভেসে যায়, কেউ কি দেখে? চুপ করে বসে থাকা পাথরগুলোও জানে, মানুষ আসলে কোনোদিন নিজের সত্যি কথা বলে না। গালভরা শব্দ, চোখভর্তি ভাষা, ঠোঁটের একটানা ওড়াউড়ি—সবই ভুল ঠিকানায় পাঠানো চিঠি। মানুষ নিজের কাছে চুপ, অন্যের কাছে গলা ছেঁড়ে চেঁচায়।

একবার ভেবেছিলাম জলের সঙ্গে কথা বলব। নদী। বৃষ্টির ফোঁটা। সিঙ্কে পড়া ধোঁয়া ধোঁয়া জলের রেখা। কেউই জবাব দিলো না। শুধু একবার, হঠাৎ, এক শীতের রাতে বালতির জলে হাত ডুবিয়ে বুঝেছিলাম—শীত জলে নয়, শরীরেই থাকে। জলের কাঁপন আসলে আমার নিজের কাঁপন। মানুষ আসলে শুধু প্রশ্ন করে। প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে, নিঃশব্দে। আমার হাতে একটা অদৃশ্য রুমাল। তাতে মুছে যাই বারবার, নতুন করে মুছি চশমা। কিন্তু এই দৃষ্টিও তো একটা মিথ্যে। যেটা দেখি, সেটা হয়ত আদৌ দেখিনি কোনোদিন। চোখে পড়ে মানেই কি সেটা সত্যি?

একবার এক ভাষাহীন পাথর নিভৃতে বলেছিল—তুই থেমে যা। চলতে থাকলে নিজেকে খুঁয়ে ফেলবি। আমি থামিনি। এখন আর চলিও না, থামিও না। শুধু মাঝবরাবর ভেসে থাকি। শব্দ ও নীরবতার মাঝখানে, ভোর ও গভীর রাতের মাঝখানে, প্রভু ও মানুষের মাঝখানে। তবু মাঝে মাঝে গলা বেয়ে একটা গুমোট ধ্বনি উঠতে চায়। আমি চেপে রাখি। কারণ আমি জানি এই শব্দ যদি বেরিয়ে যায়, তাহলে আর কোনো শব্দ থাকবে না। সব শেষ হয়ে যাবে, চুপ হয়ে যাবে, হাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। আমি তখন সত্যি সত্যিই বুঝব—ভাষা মানেই তো এক ধরনের ঢেকে রাখা মৃত্যু।

এইসব ভাষাহীন, চোখে না পড়া, নীরব কুয়াশায় হারিয়ে যাওয়া সত্যের নামই হয়তো জীবন। অথবা তার ঠিক উল্টো।

শেয়ার করুন

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments