এক.
আমার পাঠ হয়েছে একাকি,একলা চলার মতোন নির্জনতম। জীবনের অঙ্কুরকালে এমন কাউকে পাওয়া আমার ভাগ্যে ছিলো না যিনি কোন বই হাতে দিয়ে বলবেন ‘এটা পড়ো’। এমন কোন নির্মাতাও আজ অবধি এলো না আমার সৃজনের অন্দরে যার উপর যার চিন্তা কিবা মননের সৌন্দর্যে হেলান দিয়ে বাঁচা যায়। এখনও হাঁটছি এসব স্বপ্নের কোলজুড়ে, শীতশিহরিত বৃদ্ধার মতো কেঁপে কেঁপে, আশা এবং নিরাশায় দুলে দুলে, তবুও কেউ নেই একটু স্পর্শ দেবার, একটু জাগিয়ে দেবার।
আমার পাঠ তবু থামে না। নিজেকে ডুবিয়ে দিয়ে এবং কখনো পাঠ্যবইকে বিদেয় দিয়ে হলেও নিমগ্ন থাকি যতোসব ছাইপাশ পাঠে। স্বাভাবিক টানাপোড়েন কে কবুল করে জমিয়ে তুলি হাজার বই। মনে পড়ে, ঠিক যখন আমার বই থেকে গ্রহণ করবার বয়সও হয়নি, সেই থেকেই বই সংগ্রহের নেশা মজ্জায় আসন পাতে। আজও, শখের আহ্লাদের নানাকিছু এড়িয়ে শুধুই বই কিনি। মধ্যবিত্ত জীবনের হিসেব-নিকেশ, মাসান্তের বাকির খাতা, আর মাথায় চেপে বসা অনিবার্য ঋণের পাহাড় এসব সত্ত্বেও আমার শুধু মনে হয়, বইবিহীন আমার বেঁচে থাকা শক্ত, অসাধ্যরকমের শক্ত।
ছুটিতে বইয়ের বোঝা মাথায় যখন ঘরে পা রাখি, আমার ধার্মিক মা ধমকে উঠেন ব্যাগে গাদা গাদা বই দেখে। ‘কিসব হিন্দু-টিন্দুর বই লইয়া আইছত’ বলে তার কণ্ঠ ফুলে উঠে কৃত্রিম রোষে। আমার কেন যেন খারাপ লাগে না। যেনবা মায়ের প্রেমধৌত উচ্চরোলে আমি দেখে ওঠি আমার তড়পানো আগামী, অক্ষরের আলোয় ঝলমল করে কেমন সব অস্পষ্ট স্বপ্ন,
কোলাহল, বইয়ের ভেতর ডুবে থাকা এক কিশোরের মুখছবি।
দুই.
দুর্মূল্যের এই বই বাজারে যখন দেখি নিমিষেই ফুরিয়ে যায় সামর্থ্যের হাত অবগুণ্ঠনে আমার হাত যেন খোঁজে ফেরে অল্পদামের বই। পাঠের নেশা তখন উন্মাতাল, টেবিলের বই শেষ হয়ে যায় দুদিনেই। তেমনই এক বিকেলে বুভুক্ষের মতো আবিষ্কার করি পুরান বইয়ের দোকান। বহুস্পর্শের দাগে দগ্ধ,
কোনছেঁড়া, ম্যাড়ম্যাড়ে বাঁধাই, মার্জিনে লেখা লাল নীল মন্তব্য,
খিস্তিখেউড় এমনতরো হাজার বই। বিকেল হলেই কিম্বা বিরতির যেকোন সময় সদ্য আবিষ্কৃত দোকানে গিয়ে বই খোঁজি। যেমন অভ্যেস, পরিচিত লেখকের বই ছাড়া অন্য কোন আবর জাবর বই কিনি না। আর এসব পুরান বইয়ের দোকানে দুর্বল লেখকদের বই-ই বেশি থাকে। ঝকঝকে প্রচ্ছদ, ভেতরটা ফাঁকা,অর্থহীন উচ্চারণে বিদীর্ণ। তাই লেখক কিবা লেখা ছেনেছুনে বই কিনতে হয়। এখন অবশ্য স্মরণ করতে পারি আমার ওই সময়কার চেনার পরিসর ছিলো সীমিত। তখনো আমি লেখার এমনকি পাঠেরও দুধশৈশবে সামর্থ্যের দৌড় দুর্বল হলেও ভেতরটা উৎসাহে হিসহিস তুলত।
স্মৃতি স্পষ্ট, নিমাই ভট্টাচার্যের মেমসাহেব বইটার জনপ্রিয়তা আমার স্মৃতিতে ছিলো, কোথাও পড়ে থাকবো হয়তো ওই দোকান থেকে বইটা কিনি। শীর্ষেন্দুর দুরবিন আল মাহমুদের কাব্যসমগ্র সুকুমার রায়ের নির্বাচিত শিশুসাহিত্য মাহমুদুল হকের জীবন আমার বোন মহাদেব সাহার কাব্যসমগ্র মুজতবা আলীর শবনম এমন আরো অনেক বই।
কিছুদিন পর এরকম আরো কয়েকটা দোকান আবিষ্কার করি। দলবেঁধে যাই ছুটিতে, কখনো অবাধ্যের মতো মাদরাসার দেয়াল ডিঙিয়ে। ব্যাগ ভরে বই নিয়ে আসি। সারা সপ্তাহ এর ওর টেবিলে ঘুরতে থাকে এসব। স্টোর রোমে চলে নিয়ত পাঠের বিচিত্র গপ্পো। টুকটাক কলম নাড়াচাড়া, কোলাহল এবং কিছু অবুঝ চিৎকার চেঁচামেচি।
এরপর বাংলাবাজারের এক গলির দোকান থেকে কিনি মানিকের পদ্মানদীর মাঝি বিভূতির আম আঁটির ভেঁপু হুমায়ুন আজাদের একটি খুনের স্বপ্ন। এভাবেই চলে টেবিলে বই জমিয়ে জমিয়ে অকালে পেকে উঠে অকালপক্ব হবার বহুরৈখিক চেষ্টা। এসব পাঠের ক্ষেত্রে আমাদের থাকে বিবিধ বাঁধা। ব্যক্তিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং পারিবারিক বাঁধাও কি কম। পারিবারিক বাঁধা
ডিঙানো গেলেও পিছানো কিছু প্রতিষ্ঠানের বাঁধা লেগে থাকে আঠার মতোন। যদিও আমাদের অগ্রজরা কুপিয়ে কেটে কুঁদে প্রস্তুত করবার চেষ্টা করেছেন অনুর্বর এ মাটি, তবে বোধহয় সাফল্য আসেনি সামগ্রিক অর্থে। কিন্তু ভেতরে আগুনপোষা তরুণকে থামাবার সাধ্য থাকেনা। সুকান্তের আঠারো বছর
বয়সের উন্মত্ততা সবাইকেই পায় কোন না কোনভাবে। আঠারোর তরুণ ভেঙে ফেলে, গুড়িয়ে দেয়, নির্মাণ করে। সে চায় নতুনের উচ্চারণ এবং অন্ধতাপ্রসূত বুদ্ধিহীনতার বিনাশ। সে হারে না কভু, একদিন জাতি এবং তার অনাগত প্রজন্ম তাকে সেলাম ঠুকে।
তিন.
পুরান বই কেনাটা বেশি হয়েছে এ বছর। সময় পেলেই ছুট দিতাম। নদীর পার দিয়ে হেঁটে হেঁটে অদূর বাংলাবাজার এবং তার অন্ধকার গলির বইয়ের রাজ্যে। গোলচত্বর থেকে গুলিস্তানমুখী রাস্তার বামহাতিতে বসে থাকে পৌঢ়মতো একজন। সামনে বইয়ের পসরা এলোমেলো ইতস্তত। ‘চাইয়া
লন বাইচ্ছা লন, বিশ টাকা’ এ বলে সে হাঁকে, হাঁকতেই থাকে অবিরত। টুপিশোভিত হুজুর দেখলে কণ্ঠ নিচু করে বলে ‘ভালো ভালো ইসলামি বইও আছে, লন হুজুর’। আমার হাসি পায়। প্রথম কিছুদিন বই কিনে নীরবেই চলে যাই। একদিন বলে ফেলি—ইসলামি বইয়ের জন্য এখানে আসি নাই। মানে সে কল্পনাও করে নাই, হুজুররাও উপন্যাস কবিতা পড়ে। আহা, সুধারণা।
তার এখান থেকে ভালো কিছু বই কিনি। শামসুর রাহমানের কাব্যসম্ভার, হাসান আজিজুল হকের প্রেম অপ্রেমের গল্প সেলিনা হোসেনের টানাপোড়েন আল মাহমুদের সাক্ষাৎকারভিত্তিক বই কথপোকথন সাবেরের কোন একদিন। সাইফুজ্জান, মহীবুল আজীজ, মোজাফফর হোসেনের কিছু বই। তার দোকান
পেরিয়ে গেলেই ভেতরের গলিতে আরেকটা দোকান পড়ে। গলির অন্যান্য দোকানগুলো স্কুল কলেজের বইবহুল হলেও তার দোকানে থাকে শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তকের বাইরের বই। ডাঁই করে রাখা, বিস্রস্ত বিধ্বস্ত। একটার উপর একটা। মাথায় পড়ার ভয় থাকে প্রকট। দোকানির মেজাজ বেশ খিঁচড়ে, এক কথার বা একরোখা মানুষ যাকে বলে ঠিক তাই।
ওখানে অবশ্য বিশ টাকায় নয়, তুলনামূলক কমদামে বিক্রি হয়। তার সংগ্রহ ভালো বিচিত্র এবং সংখ্যায়ও প্রচুর। এখান থেকে সংগ্রহ করি রবি ঠাকুরের গল্পগুচ্ছ শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত গোর্কির শ্রেষ্ঠ গল্প, জীবনানন্দের বনলতা সেন নাম মনে নাই এমন আরো অনেক। এখনো সময় পেলে যাই। গাঁটে পয়সাপাতি না থাকলেও দাঁড়িয়ে বই দেখি। নাড়াচাড়া করি, উল্টাই পাল্টাই।
চার.
মেমসাহেব বইটা খোললেই দেখা যাবে ভাঙা ভাঙা অক্ষরে লেখা, দুর্বল ভাষায় কিঞ্চিৎ উপহারনামা। হুবহু উঠিয়ে দিলে এমন ‘আজদাহা খালা ও রুমি ডার্লিঙের জন্মদিনে নাঈম ও নাসিত’। দেখে হাসলাম একটুক্ষণ। পুরান বই কেনা বা পড়ার স্মৃতিসমগ্রে এটা আমার সবচে দুলিয়ে দেয়া স্মৃতি। স্মরণে এলেই নিজের মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে হাসি। এরপর কিছুটা নেশাও পেয়েবসে বই ঘেঁটেপিটে এমন কিছু উদ্ধারের। একবার পেলাম আস্ত একখানা চিঠি। কোন বইয়ে সেটা আর মনে নেই।
ভালোবাসার চিঠি, একদম খোলা ভাষায় বিবিধ কিছু। ওটা এখন হাতের কাছেও নেই, থাকলে ওঠিয়ে দিতে পারতাম। তবে এইটুকু মনে আছে, চিঠিটা লিখিত হয়েছিলো বিচ্ছেদমুখী কোন সম্পর্ককে কেন্দ্র করে। জানতে ইচ্ছে হয়, সে সম্পর্ক এখন কতদূর, তীরে কি ভিড়েছে নৌকা নাকি ডুবে গেছে মাঝ সমুদ্রেই। একবার পাই একাট নাম্বার। নামধামও লেখা শিরোদেশে। আর কি কিছু পেয়েছিলাম ! মনে নাই। স্মৃতিগুলো আলোড়নের, মাঝে মাঝে বৃষ্টিমুখর মনখারাপের দিনে মন্থন করতে মন্দ লাগেনা। হাজারো কালো স্মৃতির ভিড়ে এসব তবু একটু আনন্দ দেবার। নিকট পেছনে তাকিয়ে দেখছি স্মৃতি থরোথরো, হালকা নিয়ন আলোয় কেঁপে উঠা বৃষ্টিবিধৌত রাস্তা, হেঁটে চলা কিছু ছায়াছবি। কথায় সড়গড়, ভেতর কাঁপে স্বপ্নে—কলাপাতার মতো তিরতির। একি আমাদের বেদনার প্রদোষকাল!