বাঁশের খুঁটি কাটা হচ্ছে দেড় হাত লম্বা পরিমাপে। গর্ত খুঁড়া হচ্ছে ছোপ ছোপ। পর পর কয়েক বিগত ফাঁকা মাঝে। পাটাতনে বিছানো হচ্ছে ইটের আধুলি। আমরা ব্যানারের কাজে ব্যস্ত। মোটাদাগে লেখা ‘কুরবানি প্রজেক্ট’। এখনো সবিস্তারে কাজকাম শুরু হয়নি। রাত কাছাকাছি হচ্ছে। আমরা তখন বিকেলের পায়ে। নেমে যাচ্ছি ক্রমশ সন্ধ্যার দিকে। হুজুর আসছেন তাড়াহুড়ো। চলে যাচ্ছেন তারচে’ দ্রুত। কি দারুণ ব্যস্ততা আজ ওনার। কারো বসে থাকার ফুরসত নেই। যেন এলান বাজবে খানিক পরেই। দশ নম্বর সিগনাল পৌঁছেছে। যে যার কিছু গুছিয়ে নাও মুহূর্তক্ষণে।
মাগরিবের আজান হচ্ছে। তিনটা ট্রাক ধক্কর মক্কর ভীষণ ধমকে এসে দাঁড়িয়েছে মসজিদের কাছে। আমি আর উবায়েদ ছুটছি গিঁট ছাড়া বিড়ালের পায়ে। তিন নং সাতাইশটা গরু এসেছে। মাথা কাটা শিং। গায়ে পোড়া শিকে দাগ করা। এটা বর্ডার পাস তাই বুঝা গেলো। এমন হয়। চুরিচামারি সব মিশলে কুরবানির আনন্দ। বড়রা গরু নামানিতে লেগে গিয়েছেন। আমরা জারুল পাতার মতো তাকিয়ে আছি। যেন স্থির জল। আজ তার স্রোত নেই।
খুব বেশি মনে পড়ে না— তারপর ঈদ পর্যন্ত ভালো পড়াশোনা করেছি। কৃষকের মতো হাতে কাঁচি। ঘাস কাটছি। রাখাল হয়ে বারবার বন-লেদা এবড়োখেবড়ো ছিটাচ্ছি। ছড়াচ্ছি। হুঁস! হুঁস! লেজ ঘোরাচ্ছি কানের মতো। যেন কত বড় মানুষ। এভাবে আগামীকাল ঈদ দিনটি চলে এসেছে। রোজা হলে চানরাত বলতাম। নিজেদের বানানো গোয়ালে সর্বশেষ জল-খের খাওয়াচ্ছি মন খারাপ নিয়ে। ভিতরে এক অদ্ভুত শৈশব জাগ্রত হচ্ছে। হৃদয় কাঁদছে টের পাচ্ছি। বিশাল মেশিন এনে শান দেওয়া হচ্ছে ছুরি-কাঁচি প্রয়োজনীয় অস্ত্র। একেকজন খুব দেদারসে চিল্লাচ্ছে আর বলছে — এই রেতেরটা আমার। না আমাকে ব্লেডের তৈরিটা দেন। নিজেদের জবাই হাত খুব শক্ত বুঝা যাচ্ছে। এই এক জায়গায় এসে আমি হেরে যাই। ভীষণ ভয় এসবে। ধারালো চাকু। চিকচিক করছে চোখের সামনে। ভিতরে তখন জাগ্রত স্বপ্ন কাজ করে। গরুর গলায় চালাতে হঠাৎ ছুটে এসেছে আমার হাতে। আর কেচ করে হা হয়ে ওঠছে চামড়া। রক্ত ঝরছে টিন বেয়ে পড়া বর্ষাফোটার মতো। আমি কাঁদতে কাঁদতে মৃত্যুর দিকে হেঁটে যাচ্ছি।
বাড়িতে থাকলে খুব সকালে ক্ষিধে লাগতো। আমি ভাত খেতে চাইতাম। আম্মু সেমাই দিতেন। ভাজা পাক্কন পিঠা সামনে রেখে বলতেন— এসব খেতে হয় আগে। ভাত তো নিয়মিত। মাঝে মাঝে অনিয়ম কিছু ভালো। সংক্ষেপে কথা বলার ধরন আম্মুর বেশ আয়ত্ত। ফজরের পরপর ঘাস মাড়িয়ে এসব মনে করছি। থেঁতলে যাওয়া কুয়াশার মতো ভিতরে ভাঙচুর তৈরি হচ্ছে। কখনো আম্মু আসছেন। হাসছেন। বাবা ঈদগা’তে যেতে তাড়া দিচ্ছেন। ছোট’টার বেজায় গোস্বা। জুতো ম্যাচিং পরেনি পায়ে’র সাথে। আমি যেন হাফসাকে বলছি— কিরে! তোর বুঝি ঈদ নাই? মেয়েদের সাজুগুজু করতে হয়। যা গোসল-সাবান সেরে নে! তার ভিতর কোন ভাবান্তর তৈরি হয়নি কখনো। এ বোনটা আমার মায়ে’র দুখী সংসারের মতো। জীবনে এই প্রথম কোন ঈদ গুজার হচ্ছে মাদ্রাসায়। কি দারুণ অনুভূতি। দুঃখস্মৃতি। নতুন অভিজ্ঞতা। আরেকটা কোমল জীবনে পদার্পণ হওয়ার সমূহ আয়োজন থমকে যাচ্ছে।
একে একে খোঁয়াড় থেকে গরু ছুটিয়ে নিচ্ছে ছাত্ররা। হাতে রশি। বিপুল আনন্দ চেহারায়। মাঠে বিছানো ঘাসের উপর শোয়ানো হচ্ছে গরুগুলোকে। চার ছয়’জনের দামাল হাত পেট, বুক, পায়ে চেপে আছে। একজন শিং ধরে দাবিয়ে দিচ্ছে মাটির ভিতর। আমি বেঁচে আছি— এইটুকু জানাতে লেজ নেড়ে জানান দিচ্ছে গরুটা। চুরিঅলা হঠাৎ চেচিয়ে বললো— বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার। কি অদ্ভুত সমস্বর সবার। ভাষা, লাহান, আবৃত্তি একরেখা সুর। চব্বিশ ফুট দূর থেকে দাড়িয়ে যে ছোকরাটা দেখছে— অজান্তেই তার চোখ কেঁপে ওঠছে আর বলছে বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার। আমার দৃষ্টি তখন রক্তের ঝর্ণার গায়ে থেমে আছে। গতসন্ধ্যায় ভুষি খাওয়াতে নিয়ে বলেছিলাম— কাল তোর রক্ত দেখবো মাটির গতরে স্বাধীন পতাকা আঁকছে।
উবায়েদ পিছন থেকে বাহু টেনে বললো— মিন্টুচত্ত্বর যেতে হবে দ্রুত। লুঙ্গি জড়ানো পায়ে’ই হেঁটে দৌড়ে সামনে এগুচ্ছি দু’জন। সাদাটুপি ওয়ালা এক বিশাল মিছিল। হাতে ইব্রাহিমের হাতিয়ার। আমাদের দায়িত্ব নিতান্তই ঠুনকো। জবাইয়ের পর দাঁড়িয়ে থেকে পাহারা দেওয়া— চামড়াটা যেন আমাদের মাদ্রাসার হয়। সময় গড়াচ্ছে আজেবাজে গপসপে। একজন ভ্যান নিয়ে এলে— চৌদ্দটা চামড়া ওঠিয়ে দিলাম দুইজোড়া হাতে। মাসিহ হুজুর ছিলেন আমাদের জিম্মাদার। আজ ওনার ঠোঁট বেয়ে পানের পিচকারি নয়— কচিহাসি গড়িয়ে যাচ্ছে অনর্গল। এতগুলো চামড়া। মাদ্রাসার কত্ত উপকার।
সারা গা’য়ে কখন এত রক্ত ছড়িয়ে গেলো টের পাইনি। যেন যুদ্ধ বিজেতা জুলাই বিপ্লব। কিম্বা হোলি খেলে আসছি কোথাও থেকে। ভারি বিস্ময়ের ব্যাপার হলো— কুরবানির রক্ত কত সহজে ধুয়ে যায়। সামান্য সাবান পানিতেই। আমার প্রথম জাদুর মতো অভিজ্ঞতা হাসিল ছিলো সেটা। ভিতরে নিজেকে নতুন কিছু আবিষ্কারক ভাবছিলাম। বোকা বোকা চিন্তার গর্ভপাত। একটা আদুরে বিকেল। নাক ধেঁধে যাওয়া গোশতের ঘ্রাণ। যেন নিজেকে চেটেপুটে খেয়ে দেখছি কেমন।
ঘোষণা এলো পয়পরিষ্কার সেরে দু’তলায় বসে যান। অনেকগুলো দস্তরখান। ফাঁকা ফাঁকা হয়ে বসুন। আমি মাঝে পাকঘরটা বেড়িয়ে আসলাম। বিশাল ডেকচি আগুনে জ্বলছে। পাঁচজন বাবুর্চির পিঠে ঘামের মিছিল। কাঠখড়ি পুড়ছে। ঠসঠস আওয়াজ ছুটছে। প্রতিটি পাতিল গলা অব্দি গোশত টগবগ করছে। লোভ সামলানো মুশকিল এসবে। ছোটকালে ফড়িঙয়ের পিছনে ছুটা আগ্রহের মতো। আমি আর উবায়েদ পাশাপাশি বসলাম। রানের নরোম মাংস চিবুচ্ছি আর একজোড়া চোখে কলিজা খুঁজছি। বড্ড পছন্দের এসব। হাড়ের ভিতর ঘুমিয়ে থাকা ক্যালসিয়াম টেনে চুষে রাখছি পেটের গুহায়। মাঝে মাঝে বিরক্ত করছে এলাচি কামড়ে। একটা স্বর্গীয় আহারে নিজেকে হাজির রাখতে পেরেছি। এসব মূলত আনন্দের আখ্যান। একটা দুঃখের পাতায় কিছু সুখ ছিটিয়ে দিয়ে স্মৃতি ঢেকে রাখার অপেয়া চেষ্টা।
আজ এত বছর পর শৈশব ভীষণ করে তাড়া দিচ্ছে যেন। আম্মু বলতেন— বড় হয়ে গেলে আনন্দরা মরে যায়। আজ মাদ্রাসায় একটা ঈদ কাটিয়ে মনে হলো— আম্মুর কথাটা আংশিক ভুল ছিলো। ইচ্ছে তো হয় এরকম— যেন সব ছেড়ে-ছুঁড়ে এঁটেল মাটির মতো থিতু হয়ে যাই মাদ্রাসা— কুরবানির ঈদে। বাড়ি ফেরার হাজত না জন্মাক। চামড়ার পিছনে ছুটতে ছুটতে শৈশবের ঘুড়ি খুঁজে পেয়ে যাই। সেখানে একমুখো হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন হাদিসের উস্তাদ। আর পিঠে আলতো চাপড়ে বলছেন— সাবাশ বেটা। দ্বীনের জন্য কবুল হয়ে যা।
শিক্ষার্থী— জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম ফরিদাবাদ