চিরায়ত

কেন আমি ছোট্ট জানালাটি দিয়ে সবকিছু দেখি

আমি ঠিক এই জানালাটার পাশে এসে বসি। এই জানালা দিয়ে আমি সবকিছু দেখি। সবকিছু কীভাবে এই জানালা দিয়ে দেখি, এটা এক আশ্চর্য ব্যাপার নিঃসন্দেহে। ব্যাপারটা এইভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যে, আমি কোনোকিছু আসমানে ছুড়ে মারি এবং সেটা নিচে এসেই পতিত হয়। ব্যাপারটা তাইলে যা দাঁড়ায় তা হলো আমি যদি এই জানালা দিয়ে কিছু একটা দেখি তাহলে সেটা ঠিক ঠিক দেখে ওঠা যায়। ব্যাপারটা মিলাতে কষ্ট হয় আসলে যে, এই একটামাত্র জানালা দিয়ে আমি সবকিছু কীভাবে দেখি। এটার সঠিক ব্যাখ্যা হলো, আমি ব্যাপারগুলি কীভাবে দেখলাম সেটা না বরং আমি কোন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারগুলি দেখি বা আমার দৃষ্টি দিয়ে ঘটনা ও দৃশ্য মাপার যে মানদণ্ড আমি এতদিনে দাঁড় করিয়েছি সেটার দিকে খেয়াল দেয়া।

 আমার কথায় এটা হয়তো মনে হতে পারে, যে আমি এই জানালা দিয়ে সবকিছু দীর্ঘদিন ধরেই দেখে আসছি। ব্যাপারটা সঠিক বলেই মনে হচ্ছে। কারণ আমি কতদিন ধরে এখানে আছি সেটা এখন আর আমার হিসেবে নেই। যেহেতু আমি প্রতিটা দিন একইভাবে দেখে আসছি, যেমন আলো আসছে, আলো যাচ্ছে, আধার নামছে এবং আধারও চলে যাচ্ছে; একারণে আমি এটা নির্ধারণ করতে পারি যে আমি অনেকগুলি দিনই এই জানালার পাশে আছি। বিষয়টা এইভাবেও ব্যাখ্যা করা যায় যে, আমি এতদিন ধরেই এখানে আছি যে আমার নিজের চেহারা কেমন সেটাই ভুলে গেছি। শুধু জানি আমার কপাল আছে, দুটা চোখ, নাক ও ঠোট ইত্যাদি আছে, যা প্রমাণ করে আমি বনি আদমের অন্তর্ভুক্ত একজন। হ্যা রাত দিনের সম্প্রসারণ আমি টের পাই, বিলম্বগুলি টের পাই কোথাও আধারের গভীরতা অনুযায়ী ফজরের আগ পিছের মধ্যে বা আছর হতে মাগরিবের মধ্যবর্তী সময়ের ব্যপ্তির ওঠা-নামা থেকে, যা প্রমাণ করে আশপাশে থাকা একটি মসজিদের অস্তিত্ব। এটাই আমাকে মনে করিয়ে দেয় আমি আলামে মেছাল বা অন্য কোনো কল্প জগতে নাই বা মেট্রিক্সের ওই জটিল জীবনেও আমি নাই। তাইলে আমি কোথায় আছি?

 ব্যাপারটা ছিলো, যে আমি বলব আমি কী কী দেখি এবং সেগুলোর ব্যাপারে আমার মন্তব্য বা অভিজ্ঞান কী হতে পারে। কিন্তু এই আলাপে যাওয়ার আগে যে বিষয়গুলো আনুষঙ্গিকভাবেই চলে আসছে সেগুলির বিহিত না করে আগানোটা মুশকিল। কারণ সেক্ষেত্রে আমার এই অভিজ্ঞান, সবকিছু একটা জানালার ভিতর দিয়ে দেখে ফেলার ব্যাপারটা সঠিকভাবে বুঝানো সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে আমি মনে করি আমার প্রথম কাজ হলো এই এলোমেলো আলাপের থেকে বের হয়ে একটা পর্যায়ক্রম অনুসারে আলাপ শুরু করা। কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারছি না এই পর্যায়টা আমি কীভাবে করবো। কারণ যে ব্যাপারটা আমাকে সবকিছু এলোমেলো করতে সাহায্য করছে সেটা হলো নিসয়ান, ভুলে যাওয়া। যেমন আমি ভুলে গেছি কতদিন আমি এখানে আছি, ভুলে গেছি দিন-তারিখের হিসেব, জানি না আমি কোথায় আছি। এমনকি পূর্বের জীবনের অনেক ঘটনাই যখন আমি মনে করার চেষ্টা করি, যা আমাকে আজ এই জায়গায় এনেছে; তখন দেখি, এসবকিছুই দূরগত অলীকের মত জাদুবাস্তবতায় ঘেরা।

 আমি আমার কিছু স্মৃতি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করতে পারি। এটা কি কোনোভাবে আমাকে সাহায্য করবে? আমি জানি না। যেমন ধরা যাক, একদিন ভোরবেলায় আমাকে কয়েকজন মিলে ধরে নিয়ে যাওয়ার একটা ঝাপসা চিত্র। আবার এটা এমনও হতে পারে যে, জ্ঞান হারানোর আগ দিয়ে তীব্রভাবে ঝাকি খেতে খেতে আলামে যিসমানিয়্যা থেকে আলামে আরওয়াহে গমনের মত অনুভূতি। এগুলির কোনোটারই কোনো সঠিক ব্যাখ্যা এই মুহূর্তে আমার মাথায় নাই।

 খোদা তায়ালা আমাকে রহম করুন। আমি তো আমার পাপ-পূণ্যকে আলাদা করতে গিয়েই কুল পাচ্ছি না। একেকটা ঘটনা একটা চলচিত্রের মতো, যেখানে অনেকগুলি চিত্রের সম্মিলন আর সেইসব চিত্র যদি আলাদা হয়ে যায় তাইলে ওই চলচিত্র আসলে খানিক অর্থহীন হয়ে পড়ে, সামগ্রিক বিচারের যোগ্য থাকে না সেটা আর। তাই আমার ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা আমাকে শুরু করার আগেই বারবার থামিয়ে দিচ্ছে। 

 আমার মনে হয় আমার ভাষাজ্ঞান অত্যন্ত সীমিত। কিছু শব্দ ছাড়া আমি আর কিছু দিয়েই নিজেকে ব্যাখ্যা করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। ব্যাপারটা আসলে কী? হতে পারে আমি দীর্ঘদিন কথাবার্তা বলার সুযোগ না পেয়ে কথা বলার যোগ্যতাই হারাতে বসেছি বা হারিয়ে ফেলেছি। আমি যেটা বলতে চাচ্ছি সেটা হলো, দীর্ঘদিন আমি এখানে আছি আর এটা একটা খুবই ছোট্ট জায়গা, যেখানে ওই একটা জানালা দিয়ে যৎসামান্য যা আলো এসে থাকে। নয়তো আমি কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলার মত করে দৃষ্টিশক্তিও হারিয়ে ফেলতাম। খোদা তায়ালার অশেষ মেহেরবানি, যে তিনি আমাকে সামান্য হলেও সুযোগ দিয়েছেন, বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু আবশ্যক ততটুকু সুবিধা আমি পাচ্ছি। এই যেমন সকালে এক টুকরা রুটি আর গলা ভিজানোর জন্য পানি এবং সন্ধ্যায় কখনো-সখনো সামান্য কিছু খাদ্য, যার নাম আমার জানা নাই বা জানলেও আমি ভুলে গেছি। 

 আমি সঠিকভাবে শুধু এটুকু মনে করতে পারি, এল মোরাব্বা একটা গানের ভিতর বলছে, সামাহনি, আনা সমতি

সামাহনি, আনা সমতি

সামাহনি, আনা সমতি।

এই একটা লাইনই আমার মাথায় ঘুরতে থাকে বারবার আর আমি ভুলে যাই ওই সমস্ত দাওয়া ও তাবশির, যেগুলি আমাকে এমনই পর্যদুস্ত করেছে, যে আমি কখনো কখনো ভাবি খোদা কি আমাকে মানবের শরীরে একটা তেলাপোকা রূপেই বানিয়েছেন! নাহয় মানুষের কি এই ছোট্ট কামরায় বন্দি থাকার কথা, না কি মানুষের জন্য এই ছোট্ট জানালাই সমস্ত কিছুর তর্জমা করে দেয়! আমি এখন আর প্রশ্ন করি না, প্রশ্নগুলি মূলত ছিলো কিছু আত্ম-জিজ্ঞাসা৷ নিজেরে আর কতভাবে আমি পর্যদুস্ত করব, কত কত উত্তরহীন প্রশ্ন জমা হয়ে আছে সেগুলির পরে আমি এই ব্যাপারটি, মানে পুরা প্রক্রিয়াটাকেই ভয় পাই এবং এড়িয়ে চলি।

 এল মোরাব্বার এই লাইনটা আমি তখনই মাথায় গেথে নেই যখন আমাকে বারবার জিজ্ঞাসা করা হয়, আমি কাউকে খুন করেছি কি না। এটা ছাড়াও জিজ্ঞাসা করা হয়, আমি কেন বরিশালে গেছি বা ওই পরিবারের সাথে আমার কী সম্পর্ক। আমি প্রথমদিকে কী কী উত্তর দিয়েছি জানা নাই। এখন অবশ্য আমাকে আর জিজ্ঞাসা করা হয় না। শেষ কবে এগুলি জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হয়েছি, আমার মনে পড়ে না। হয়তো সামাহনি, আনা সমতি; এই জিকিরের ফলেই আমাকে এখন নিরব থাকার জন্য স্থায়ীভাবে এই ঘরে আটকে রাখা হয়েছে। যেন বা আমাকে বলা হলো, নাও তুমিই তো চাইছো চুপ থাকতে এখন দেখি কত পারো চুপ থাকতে। একটা ব্যাপার এখানে খোলাসা করা দরকার যে, আমি এটা আগে বুঝিনি যে, বনি আদম চুপ থাকতে পারে না। আমি যদি চিৎকার করি বা কথা বলতে চাই তাহলে আমাকে শাস্তি পেতে হয়। কখনো বস্তায় ভরে শূন্যে ঝুলিয়ে পেটানো হয়, কখনো চেয়ারের সাথে বেধে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়, কখনো এমনভাবে আমাকে ঘুরানো হয় যে, আমার মনে হতে থাকে চোখ ফেটে ঘেলু বেরিয়ে যাবে, কানের তালা ফেটে যাবে; যেন বা রোজ কেয়ামত সমাসন্ন। এখান থেকে আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে, এখানে এই ঘরে থাকার অর্থ মোটেও শান্তিতে থাকা নয়৷ কারণ অনেক সময় দীর্ঘকাল দিনের আলো না পড়ায় বা বিভিন্ন কারণে শরীরে ছড়িয়ে পড়া ঘা আর দাঁতের ফাক দিয়ে গড়িয়ে পড়া রক্তের ধারা আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয় তেলাপোকাটি শুধু বেচে আছে, তার পাখা কেটে দেওয়া হয়েছে, তার ঘ্রাণ শক্তি কেড়ে নেওয়া হয়েছে, তাকে শুধু উল্টো করে ফেলে রাখা হয়েছে এবং একদল দর্শক তার বেচে থাকা, উঠে দাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা দেখে দেখে আনন্দ-উল্লাস করছে।

 একটা একটা করে আমি ঘটনাগুলি ব্যাখ্যা করব বলে নিয়ত করেছি। আমি যখন ওই পরিবারটির সাথে থাকতাম তখন আমরা বিভিন্ন বাসা পাল্টাতে থাকতাম। কারণ আমার যতটুকু মনে পড়ে, আমি অনেক রকম কামরায় থেকেছি। কোনোটা গোল, কোনোটা চারকোনা, কোনোটা খুব সংকীর্ণ আর কোনোটা অন্ধকার। এটুকু আমার মনে পড়ে। তবে এই পরিবারের সাথে আমার কতটুকু সম্পর্ক, রক্তের সম্পর্ক আছে কি নেই তা আমি মনে করতে পারি না। এই হলো অসংখ্য টুকরা স্মৃতির একটি৷ এই ঘটনাটাকে আমি এই জানালা দিয়ে দেখা দৃশ্যের মতো করেই ব্যাখ্যা করি। এগুলি ঘটনা, যা আমার স্মৃতিতে টুকরো টুকরো চিত্রের মত ভাঙা কাচের গুড়াগুলির মত ছড়ায়ে আছে; সবকিছুই মূলত দূরগত দৃশ্য, যা না যায় ধরা না যায় সেইসব চিত্রতে নিজেকে উপস্থিত করা। 

 এই ছোট জানালা, যাকে ঘুলঘুলিও বলা চলে; এখান থেকে সবকিছুকে আমি দেখি অসাধ্য ও কল্পনারূপে। অথচ যখন আমাকে উল্টা করে ঝুলিয়ে পেটানো হয় তখন আমি ঠিকই বুঝি যে, এসবকিছুই বাস্তব সত্য। যদিও জানালার বাইরে ঠিক কী রয়েছে, তা কেমন বা বাস্তব না অবাস্তব, আমি জানি না। এই একটা প্রশ্নের সমাধান বের করতে যে আমাকে কতগুলি দিন ও রাত কাটাতে হয়েছে তা বলা সম্ভব না। সর্বশেষ আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেহেতু জানি না আমি কই আছি, কেন আছি আর আমার স্মৃতি যেহেতু আমার সাথে গাদ্দারি করেছে সেহেতু এটাই সত্য হবে যে, আমার সাথে সমগ্র বিশ্বই গাদ্দারি করেছে, যা মূলত জানালা দিয়ে দেখা কিছু চিত্র, বাতাসে ভেসে আসা ঘ্রাণ ও কিছু কিছু আওয়াজ যার বাস্তবতা আমার কাছে ওই ঘূর্ণনের সময়কালে কানে বাজতে থাকা শো শো আওয়াজের মতন, যার শেষটা হতো দুনিয়া আমার সামনে নিভে যাওয়া বা নাক দিয়ে রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে। 

 আমি এটাও ভেবেছি যে, আমার মাথায় এই লাইনটা, ও তিলকাল আইয়্যামু নুদাউইলুহা বাইনান নাস; বারবার ঘুরে ঘুরে আসে। এটা কোথা থেকে আসে এখন আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। এমনটাও হতে পারে যে, দেয়ালে বিভিন্ন দাগ ও চিহ্ন যে রয়েছে সেগুলিই কোনোকালে যখন আমার পূর্বের পরিচয় সম্পর্কে আমার মধ্যে সত্যাসত্য ধারণা ছিলো তখন কোনো অর্থ গেথে দিয়ে গেছে। আমার বিচারবুদ্ধি যখন কিছুটা সুস্থ ও সজাগ থাকে তখন আমি এসমস্ত ব্যাপার নিয়ে ভাবি। ভাবি হায়, এই কামরা কারা বানালো, আমার আগে এখানে কি আর কাউকে রাখা হতো, তারাই কি এসব ম্যাসেজ আমাকে দিয়ে গেছে যে, দেখো এইখানে আমরাও ছিলাম, এটাই শেষ না। এটা যদি শেষ-ই হতো তাহলে আমরা এখন কই! এভাবে যখন ভাবি তখন আমার কাছে জানালা দিয়ে সমস্ত কিছু বিচার করার প্রক্রিয়াটি বাধাগ্রস্ত হয়। মনে হয় আমার এই বিচারব্যবস্থা ভুল ধারণার উপর গড়ে উঠেছে। আমি তখন আশ্চর্য হয়ে যাই আর ওই সমস্ত টুকরো স্মৃতিগুলি জোড়া লাগিয়ে একটা পূর্ণ চলচিত্র নির্মাণের চেষ্টা করি। এসব করতে গিয়ে মাঝে মধ্যে মনে হয়, আমি কি সত্যিই কিছু করেছি না কি জন্ম থেকেই কিছু চিত্র দিয়ে আমাকে বলা হয়েছে, নাও দেখি এগুলি জোড়া লাগাও। যেদিন জোড়া লাগাতে পারবা সেদিনই তোমার মুক্তি। অন্যথায় উল্টো ঝুলিয়ে তোমাকে বেদম পেটানো হবে। হায় খোদা আমার অপরাধ কী ছিলো?

 মূল ব্যাপার হলো এই জানালা দিয়ে সবকিছু দেখার মালাকাটা আমার হাসেল হয় নানাবিধ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। বিশেষ করে আমাকে যখন দড়ি দিয়ে বেধে উল্টা করে পেটানো হতো আর আমি এর থেকে মুক্তি পেতে চাইতাম তখন মাঝে মধ্যে আমার ভিতর এই দিব্যদর্শন তাওয়াজ্জুহ দিতো যে, এই যে এইভাবে তুমি মার খাচ্ছো আর এর থেকে মুক্তি পেতে চাচ্ছো এটাই হলো সমস্ত ঘটনা ব্যাখ্যা করার চাবিকাঠি।

 একবার আমাকে পেটানোর পর বলা হলো, দেখ আসলে এটা তো আমাদের জন্যও একটা পেইন। তোমার সাথে তো আমাদের ব্যক্তিগত কোনো শত্রুতা নাই। আমাদের কিছু সিম্পল কোশ্চেন আছে এগুলির জবাব দিয়ে দিলেই তো তোমার সাথে আমাদের আর কোনো ঝামেলা নাই। আমি সেদিন তাদেরকে ব্যাখ্যা করলাম যে, আমি বরিশালে ওই পরিবারের কাছে কীভাবে গিয়েছি, বা আমি যে নিজেকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করছিলাম এটা কেন করছিলাম। তখন তারা আমার সাথে ভালো ব্যবহার করলো। কিন্তু পরের দিনই তারা আবারও আমাকে উল্টো ঝুলিয়ে পেটালো৷ আমি বুঝলাম যে, আসলে সমস্ত কিছুই এই পেটানো আর মার খাওয়া থেকে নিজেকে বাচানোর চেষ্টার মাঝেই নিহিত।

 পরবর্তীতে যখন আমি এই বন্দিশালা থেকে মুক্তি পাই এবং ক্ষমতার পালা বদলে নিজেকে নিয়ে আশাবাদী হতে শুরু করি তখনো দেখি আবারও আমার পিছু নিয়েছে সেই একই প্রশ্ন। আমি তো এই প্রশ্নের উত্তর আগেই দিয়েছি। তাহলে এখন কেন আবার এই প্রশ্নই আমাকে করা হচ্ছে! বুঝলাম ব্যাপারটা এটাই যে, ওই জানালা দিয়ে সমস্ত কিছু ব্যাখ্যা করা ছাড়া আমার আর কিছুই করার নেই। 

 এই জানালাটা দিয়ে একটা দেয়াল দেখা যেত৷ একদিন এই দেয়ালে একটি বিড়াল বসে আছে। একটু পর একটি পাখি এসে সেই দেয়ালে বসলো। পাখিটি বসার সাথে সাথেই বিড়ালটি পাখিটার উপর ঝাপিয়ে পড়লো। পাখিটি বিড়ালের থেকে নিজেকে বাচানোর জন্য ঝাপটাঝাপটি করতে থাকলো। আমি এটুকুই দেখেছি। নিয়ত আমি নিজেকে ওই পাখিটির জায়গায় দেখতে পাই। যা কিছুই ঘটে আমার সাথে, দেখি ওই পাখিটার মতোই আমাকে থাবা দিয়ে ধরা হচ্ছে। ব্যাপারটা এমন না যে, ওই ঘটনাটা আচমকাই ঘটে গেছে। ব্যাপারটা ঠিক ওইভাবেই ঘটার ছিলো। পাখিটার ওইখানেই বসার কথা ছিলো। পাখিটা বসলে যে বিড়ালটা তার উপর ঝাপিয়ে পড়বে না এরকম কোনো সম্ভাবনাও ছিলো না। তারপরেও পাখিটা ওই জায়গাটায় গিয়েই বসলো। হ্যা এইখানে একটা কথা থাকে যে, পাখিটা কি জানতো না যে, বিড়ালটা তাকে শিকার করবে। এখানেই আমার আর পাখিটার মাঝে পার্থক্য৷ আমি জানি আমাকে শিকার করা হবেই, তাও ওই জায়গায় আমার যাওয়া লাগলো।

 ওইখানে কেন যাওয়া লাগলো এটা ভাবার বিষয়। আমি যখন ওই ছোট্ট কুঠুরিতে কারাবাস করছি তখন এই ঘটনা এবং আমার পূর্বাপরের অনেক ছোট ও ঝাপসা চিত্র বিবেচনা করে দেখেছি। যা দেখলাম তা হলো, ঠিক ওই বিড়ালটার জায়গাই আমার দরকার ছিলো। আমি আসলে বিড়ালটার ওই জায়গায় যেতে চেয়েছি। কেন চেয়েছি, বা সেই বিড়ালকেই কেন তাড়াতে চেয়েছি সেটা নিয়েও আমি ভেবেছি। ভাবার পর আমার মনে হয়েছে বিড়ালটা যা চেয়েছে আমিও তাই-ই চেয়েছি। বিড়াল আর আমার ব্যাপারটা তাই একে অপরের অস্তিত্বের প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছিলো৷ বিষয়টা কি এমন না যে, আমি যদি ওই বিড়ালের জায়গাটা দখল করতে পারতাম তাহলে ওই বিড়ালটা আমার জায়গাতে অর্থাৎ এই কুঠুরিতেই এখন থাকতো! 

 এটা ভাবার পর আমি আরো বেশি করে নিরব হয়ে যাই। নিজের স্মৃতিশক্তির পর নিজের যৌক্তিকতা ও চিন্তাশক্তি নিয়েও আমি সন্দিহান হয়ে পড়ি। মনে হয়, তাহলে এই যে আমাকে আটকে রেখে এইভাবে অমানুষিক নির্যাতন করা হচ্ছে তা কি বৈধতা পেয়ে যায়? প্রশ্নটার উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমি দেখি, এটা অবশ্যই জুলুম৷ আবারো শুরু হয় বিভিন্ন ব্যাখ্যা ও প্রশ্ন-উত্তর খেলা।

 প্রথমত আমি চিন্তা করি, বিড়ালটা আর আমি যদি একইসাথে ওই দেয়ালে অবস্থান করি তাহলে ব্যাপারটা কেমন হতো। এইটা ভেবে হাসি পাচ্ছে যে, ওই সময় এমন বলদের মত প্রশ্নও আমি নিজেকে করেছি, অথচ আমার সামনে আরো কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন অপেক্ষায় রয়েছে। ব্যাপারটা তো আসলে কোনোভাবেই সম্ভব না। সহাবস্থান হয় সমশ্রেণির মধ্যে, যদিও সেখানে যে আসলে সহাবস্থান হয় তা না। বরং একই দেয়াল থেকে তারা পাখিটি বসার জন্য অপেক্ষা করে। ওই অপেক্ষার সময়টুকুই হলো তাদের সহাবস্থান। আর আমার ক্ষেত্রে তো ব্যাপারটা অস্তিত্বের, হয় আমি থাকবো নাহয় সে থাকবে। 

 এখন কথা হলো তারটা জুলুম হলে আমারটা কেন জুলুম হবে না। এর সরল উত্তর হয়তো, একটা জুলুমকে থামাতে কখনো কখনো জালেম হওয়া লাগে। তবে ব্যাপারটার আরেকটা ব্যাখ্যা আমার মাথায় এসেছিলো। এই ব্যাখ্যাটা একটা ঘটনা থেকে আমি বুঝায়ে বলতে পারি।

 যখন আমি বরিশালে যাই, নিজেকে পরিবর্তন করছি, আদর্শিকভাবে নিজেকে শক্তিশালী করছি তখন আমি মাঝে মধ্যেই রাত্রি জাগরণের জন্য বাইরে চা খেতে যেতাম। একটা দোকানে বেশ কিছুদিন যাবৎ আমার যাতায়াত ছিলো। সেই দোকানের পাশে একটা কালো কুকুর থাকতো। কুকুরটাকে দেখে প্রায়ই আমার মনে হতো, ও কিছু খেতে চাইছে। আসলেই কুকুরটাকে ক্ষুদার্থ মনে হতো। এভাবে কিছুদিন চলে যায়, কুকুরটাকে প্রতিদিন এভাবে দেখতে দেখতে আমার মনে হয়, ওকে কিছু খাওয়ানো আসলে আমার মানবিক দায়িত্ব। 

 আমি প্রায়ই কুকুরটাকে কেক বা রুটি খাওয়াতাম। একটা সময়ে দেখি, আমি গেলেই কুকুরটা আমার দিকে ছুটে আসতো। এরপর কিছুদিন অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা সংকীর্ণ সময় আমি পার করছি সময়ে কুকুরটাকে আমি খাওয়াতে পারছি না। কুকুরটার উচিত ছিলো আমার প্রতি তার আবদার ছেড়ে দেওয়া। কিন্তু সে তা না করে আমার কাছেই আসতে থাকলো এবং একটা পর্যায়ে সে আমার প্রতি কিছুটা অসহিষ্ণু হয়ে পড়লো। এমনই এক দিনে আমি খুব ক্ষুদার্থ, চা দিয়ে রুটি ভিজিয়ে খাচ্ছি সেই সময়ে কুকুরটা এসে আমার হাতে থাকা রুটিতে কামড় বসালো। ব্যাপারটা আমার পছন্দ হয়নি। আসলে আমি তখন এতটাই রেগে যাই যে, পাশে পড়ে থাকা একটা ভাঙা তক্তা নিয়ে কুকুরটাকে বেদম পিটাই। 

 কুকুরটা পরবর্তীতে বেচে গিয়েছিলো কি না বা সেই আঘাতে মরে গিয়েছিলো কি না, তা আমার মনে নাই। কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে আমিই তাকে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে গেছিলাম যে, তার আমার কাছে কিছু চাওয়া বা দাবি করার অধিকার হাসেল হয়েছিলো। এটার যৌক্তিকতা কতটুকু সেটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু এই যে তাকে আমি প্রহার করেছি এটা তার পাওনা ছিলো কি না! 

 আমিও ঘটনাগুলি এভাবেই কিছু কিছু স্মৃতি আর এই বদ্ধ ঘরের ছোট্ট জানালা দিয়ে দেখা অলীক জগত (অন্তত দীর্ঘ একটা সময় আমার এমনটাই ধারণা ছিলো) আমার বিচারবুদ্ধিকে যেভাবে চালিত করেছে তাতে করে আমি দেখি, আমি যখন ওই বিড়াল না হবো বা দেয়ালের উপর অবস্থান করা অন্য আরেকটা বিড়াল না হবো ততক্ষণ পর্যন্ত আমি ওই ছোট্ট পাখিটা, যার উপর ঝাপিয়ে পড়া হয়, বা ওই কুকুরটা যার মনে হয় আমার হাতে থাকা রুটির উপর তার অধিকার আছে। প্রকৃত পক্ষে জানালা দিয়ে দেখা বা ব্যাখ্যা করার প্রবণতাটা আসল বিষয় নয়, কেন আমি জানালা দিয়ে সবকিছু দেখি এবং ব্যাখ্যা করি বা ওই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার যে প্রক্রিয়া; এটিই হলো আসল বিষয়।

শেয়ার করুন