নানী যেদিন মারা গেলেন, সেদিন কোথাও ঝুম বৃষ্টি হয়েছিল। কাঠফাটা রোদের ভেতরও আমার জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছিল। আমি বন্ধুদের আসরে বলতাম, কোথাও ঝড়-বাদল হলে হিমেল বাতাস শুষ্কভূমিতে ঝড়ের বার্তা পৌঁছে দিয়ে আসে। নানীর ইনতেকালের দিন এই অভিজ্ঞতা আমার আরো পোক্ত হয়েছিল।
জানাযা-দাফনে শামিল হওয়ার জন্য আমরা রওনা করেছিলাম রাতের গাড়িতে। রাত তখন দ্বিপ্রহর। আমার কাছে রাতের তৃতীয়াংশের প্রথমটুকু ভালো লাগে। এ সময় ব্যস্ততা থাকে, কোলাহল থাকে। সন্ধ্যার লালিমা মিশে যাওয়ার পর আকাশে থাকে সাদা আভা। শেষরাতের চেহারাও সুন্দর। নিঝুম, স্নিগ্ধ, মোলায়েম। আকাশ ছেয়ে থাকে পবিত্রতায়। মাঝের অংশ অস্বস্তির। না কোলাহল, না নীরবতা— কেমন অস্থির গুমোট, রহস্যময়। বাজে রকমের আঁধার নামে এই সময়।
আমি পথে যেতে যেতে অন্ধকারের মধ্যে নানীর মুখ দেখছিলাম বারবার। নানী খুব মিষ্টি করে ডাকতেন। সেই ডাকে একটা মিহি তরঙ্গ ছিল। এতদিন আমি তা শুনিনি। শুনতে পাচ্ছি এখন; এতদিন পরে— এই আঁধার রাতে নির্জন পথের মধ্যে চলতে চলতে।
আমার নানী যখন বউ হয়ে এসেছিলেন নানার ঘরে, তখন তিনি বালিকা। সংসার বুঝে উঠতে তার সময় লেগেছিল। মায়ের মুখে নানীর শৈশবের কথা কিছু কিছু শুনেছি। একটু মনে করতে চেষ্টা করছি। নাহ, অস্পষ্ট সেই স্মৃতিগুলো এই বিজন রাতের অন্ধকারে আরো ধোঁয়াশা হচ্ছে বুঝি।
নানী শেষ বয়সেও হাঁটতে পারতেন। সেই ডুমুরশিয়া গ্রাম থেকে নদী আর স্থল মিলিয়ে সাত-আট কিলো ভেঙ্গে চলে আসতেন তার বিছানায় পড়া মেয়েকে দেখতে। সাথে করে আনতেন চালের মোয়া, বাড়ির গাছে ধরা বিচি কলা, নারকেলের নাড়ু। আমরা নানীর হাত থেকে খাবারের পুটলিগুলো কেড়ে নিতাম। নানীর কানে কানে বলতাম, আর কী আনছো?
নানীর মুখের কাছে মুখ নিলে পাওয়া যেত তাজা মোহিনী জর্দার ঘ্রাণ। আমরা নানীর চিবানো পান ভাগাভাগি করে নিতাম। নানী বলতেন, ছাওয়ালগুলোর অবস্থা দেহো! এই রাতের পথে যেতে যেতে সেই মোহিনী জর্দার ঘ্রাণও নাকে এসে লাগছে।
নানীর মাটির ডোয়া করা ঘরটায় বেড়ার ফাঁক দিয়ে শীতের কনকনে বাতাস ঢুকত। আমরা লেপের নিচে ঢুকে ভোরের অপেক্ষায় থাকতাম। মাঝরাতে বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হলে নানীকে ডেকে তুলতাম।
মাটির ঘরে ছোট্ট কোণাটায় খেজুরের পাটি বিছিয়ে নানী নামায পড়তেন। নামাযের পর তাসবিহ জপতেন ঘোমটা দিয়ে। আমরা দৌড়াদৌড়ির ফাঁকে নানীর জায়নামাযে হামলে পড়তাম। গলা ধরে ঝুল দিতাম আর কড়া করে শাসাতাম— ওই নানী, গল্প শোনাবা না!
নানী ঘটনা শোনাতেন। অমাবস্যা রাতে নানার পেছন পেছন পেত্নি আসার ঘটনা আমরা কান খাড়া করে শুনতাম। ভয়ে কুকড়ে যেতে যেতে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলতাম। গল্পের মাঝপথে নানীকে থামিয়ে দিয়ে দাঁত কুড়মুড় করে বলতাম, নানী, ওই পেত্নিডারে একবার পাইলে কী যে করতাম!!!
নানী অনেক শোলক জানতেন। পুঁথি মুখস্থ ছিল সারে সারে। বলতেন যখন, মাগরিবের পর বারান্দায় পাটি বিছিয়ে বসতাম গোল হয়ে। মুড়ি আর খেজুরের গুড় নিয়ে বসে হা করে নানীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম অন্ধকারের মধ্যে। নানী শুরু করতেন—
দেখরে মনা তুই কি এখন আমার সাথে পারিস?
আমার সাথে লাগলে বাজি ঠিক যেন তুই হারিস!
দেখ না এবার বাবার সাথে কলকাতাতে গিয়ে
কত জিনিস দেখে এলাম, কতই এলাম নিয়ে!
এরপর শুরু হতো সেই দেখা আর নিয়ে আসার ফিরিস্তি। আমরা বুঝতাম কতক; বেশির ভাগই যেত কানের ওপর দিয়ে। তবু ঘুম ঢুলুঢুলু চোখে নানীর দিকে তাকিয়ে থাকতাম এক নাগাড়ে। কখনো বা শুনতে শুনতে পাটি আর মাটি জড়িয়ে শুয়ে পড়তাম। সেই মাটির সোদা গন্ধ লেগে আছে আমার শৈশবের গায়ে।
আমার বুঝ-বুদ্ধি হওয়ার পর নানার কবর দেখেছি। তিনি দুনিয়া ছেড়ে গেছেন আমার জন্মের আগে। ডুমুরশিয়া গোরস্থানের ভেতর এক গর্তওয়ালা কবর ছিল নানার। নানী যখন আমাদের হাত ধরে গোরস্থানে নিয়ে যেতেন, কাছে দাঁড়িয়ে গর্তের ভেতর ভালো করে তাকাতাম— নানাকে দেখা যায় কিনা। নানী বলতেন, এমনি কি দেহা যায় রে মনি? তোর নানা এহন আল্লার কাছে। আমি বলতাম, নানী, তুমি নানার সাথে গেলা না ক্যা?
নানী বলতেন, আমার সময় হলি আমি ঠিকই যাবানি। নানীরও যে সময় হতে পারে, এ কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম।
নানী ছিলেন আমার মায়ের সদৃশ; না কি মা নানীর সদৃশ— আমি আজো ঠাহর করতে পারি না। নানী আম্মুর উঁকুন বাছতেন ঘরের সিঁড়িতে বসে। দুই বোন যেন; পার্থক্য শুধু— একজনের চুলে পাক ধরেছে। আরেকজন কালোকেশী।
আম্মুর ইনতেকালের পর নানী দুইজনের ঘাড়ে ভর করে এসেছিলেন মেয়েকে দেখতে। কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়ে বলেছিলেন, আল্লাহ, তুমি আমার আগে আমার মেয়েরে নিয়ে গেলা!
নানীও চলে গেছেন আজ। আমি বোধহয় কাঁদতে ভুলে গেছি। আজকের এই নিঃসঙ্গ রাতে তুমুল গাঢ় অন্ধকারের ভেতর তলিয়ে যেতে যেতে আমি ভাবি— সবাই এভাবে চলে যায়।