ছুটিতে বাড়ি এলে প্রতিবার ব্যাগ বোঝাই করে বইপত্র নিয়ে আসি। এবারও একগাদা বই নিয়ে এসেছি। দুয়েকটা বই ঢাউস সাইজের আর বাকিগুলো কৃশকায়। ইচ্ছা করেছি, ছুটির দিনগুলোতে সব পড়ে শেষ করব। কারণ শহরে আমি যেখানে থাকি, সেটা মস্ত এক বইঘর। দিনরাত বইয়ের আবহে ডুবে থাকি বলে নিজেকে ভরপুর লাগে। এর শূন্যতা টের পাই এ পরিবেশ থেকে বাইরে এলে। কিন্তু এবার এ ইচ্ছার বিন্দুবিসর্গও পূরণ হচ্ছে না।
প্রতিদিন একটি বই নিয়ে বাড়ির সামনে তেঁতুলতলায় বসি। তেঁতুলবন আলোড়িত করে বয়ে যায় হাওড় হাওয়া। জায়গাটা বেশ খোলামেলা ও ছায়াচ্ছন্ন। সবসময় মানুষের আনাগোনা লেগে থাকে। লোকজন ছায়ায় বসে বাতাস খায়, শরীর জুড়ায়, গালগপ্পো করে। এরকম একটা জনবহুল জায়গায় আমি বই নিয়ে আত্মমগ্ন হওয়ার চেষ্টা করি। নিজের জগতে ডুবে থাকি। চারপাশের কোলাহল, মানুষের কথাবার্তা আমার কানে ঢুকে না।
দুয়েক পাতা পড়ার পর মন কেমন উদাস হয়ে যায়। নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকি হাওড়ের দিকে। ঢেউখেলানো হাওড়ের জলসম্ভার আমাকে আহূতি দেয়, অথইয়ে বাইচালি করতে ডাকে। মাথার ওপরে পাতার চাঁদোয়া। এর দোলায়িত সবুজ দৃষ্টিকে স্নিগ্ধ করে। খুব কাছ দিয়ে উড়ে যায় দুয়েকটা পরিচিত পাখি। ওদের পাখসাট আর কাকলি ভালো লাগে। দারুণ অভিভূত করে শ্রাবণের আকাশ। চোখের জানালা গলে দৃষ্টি স্থির হয় সেখানে।
কোলের ওপর বই মেলে আকাশের মতিগতি বোঝার চেষ্টা করি। এই রোদ, এই বৃষ্টি। ছাইরঙা মেঘগুলো দক্ষিণ দিগন্ত থেকে বাতাসের তোড়ে উড়ে যায় উত্তর দিকে। ওদের বুঝি বড্ড তাড়াহুড়া। তাই ওড়ার পথে ধাক্কাধাক্কি করে ঝরিয়ে দেয় ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। বেশ একটু ঝরার পর ক্ষান্ত দিয়ে চলে মেঘের উড়াল। হঠাৎ ছিন্ন মেঘের ফাঁক গলে রোদেলা মুখে উঁকি দেয় সূর্য। আলোর দীপ জ্বেলে মেঘমালার যাত্রা নিরাপদ করে।
দুপুর গড়িয়ে যায়। তেঁতুলতলার আড্ডা শান্ত হয়ে আসে। লোকজন চাঙা হতে ফিরে যায় ঘরে। আমি ঝিম মেরে বসে থাকি ছায়াবীথি তলে। কোলের ওপর বই মেলে নিসর্গ পাঠ করি। আমার আর কালো অক্ষরের বই পড়া হয়ে ওঠে না।
আরেক দিনের কথা। অনেক দিন পর আজ একটা আয়েশি দুপুরি ভোজ হলো। মায়ের হাতের রান্না, সবই আমার পছন্দের পদ। লাউয়ের পাতাডগা, বিচিসুদ্ধ শিম, গোল আলু, কচি বেগুন সহযোগে কড়াই শাক, পুঁটি মাছের শুঁটকি ভর্তা, বেতই মাছের নিলহা সালুন আর গরু গোশতের ভুনা। দেশি গাইয়ের দুধও ছিল। আম্মা বললেন, ভাত দিয়ে মেখে খেতে। কিন্তু আমি দুধমাখা ভাত খেতে পারি না। তাই বলে দিয়েছি, বিকালে গেলাস ভরে খাব।
বাহারি ভোজের পর ভাতঘুম দিয়ে মন চাচ্ছিল। ভাবলাম, না ঘুমিয়ে বই পড়তে পড়তে ছায়াবিলাস করলে দারুণ হবে। তাই চেয়ার নিয়ে চলে এলাম তেঁতুলতলায়। সাথে নিলাম সাব্বির জাদিদের ‘গোত্রহীনের ইতিকথা’ বইটি। এটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনভিত্তিক প্রথম উপন্যাস। ডকুফিকশন পড়তে খুব ভালো লাগে। এরকম কিছু কাজ করার ইচ্ছা আছে আমার। ‘আজ জানে কি জিদ না কারো’ এর তালে তালে পড়তে শুরু করলাম উপন্যাসটি।
গল্পটায় বেশ সম্মোহন আছে। গদ্যভাষা ও কাহিনি-সংলাপ অপূর্ব, চমৎকার। একনাগাড়ে পনেরো পাতা পড়ে ফেললাম। হঠাৎ অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, বইয়ের পাতায় আর মন বসছে না। দৃষ্টি কেবল উদাস উড়ালে চলে যাচ্ছে এদিকওদিক। পাঠের স্রোত বাঁক বদলাচ্ছে। কালো অক্ষরের কাহিনীর চেয়ে আলো ঝলমলে নিসর্গ পড়তে মন চাচ্ছে বেশি।
আমাকে আহূতি দিচ্ছে গাঙের ওপারের জীবন। মোহিত করছে চারপাশের প্রকৃতি। মুকুলিত আমগাছ, থোড়অলা কলাগাছ, কিশলয়পূর্ণ কদমগাছ, পিটুলি গাছ। আহূতি দিচ্ছে কাদামাড়ানো পগার—যেটি এখন সবুজ ঘাসে ছাওয়া; একটি ডিঙি পড়ে আছে মড়ার মতো। তুলতুলে রাজহাঁসের ছানাগুলো ঠুকরে ঠুকরে ঘাস খেতে খেতে প্যাঁক প্যাঁক করে ডাকছে আমাকে। আহূতি দিচ্ছে ধুলোস্নানরত চড়ুইদম্পতি। গাংধোয়া বাতাস জুড়িয়ে দিচ্ছে দেহমন।
কী পড়ব আমি, মনজাগানো বইয়ের জীবন নাকি চোখজুড়ানো নিসর্গ জীবন? দোলাচলে পড়ে আছি। স্থির করতে পারছি না কিছুই।





