যেখানে মেঘালয়ের হাতছানি

ইবতিদায়ে সফর
১১ই অক্টোবর
মঙ্গলবার

সিলেটগামী পথটা সৌন্দর্যে মনোহর, সবুজে সবুজে ছাওয়া। ট্রেনে এই নিয়ে দ্বিতীয় দফা উঠেছি। ঠকঠক শব্দে আর দুল দুলোনিতে বেশ আনন্দ লাগছে। খুব যে, তা না। খানিকটা অস্বস্তিও হয়েছে বৈকি কিন্তু এক দারুণ অনুভূতির ভিতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি গন্তব্যে। সন্তর্পনে। সময়টা বর্ষার। আকাশ জুড়ে দলা পাকা মেঘদল। ঝিরঝিরি বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যা দূর আকাশে ধীরে ধীরে নামছে। মাটির সোদা গন্ধ অনুভব করছি হৃদয় দিয়ে। ট্রেন পথের দুধার ধরে গেড়ে বসেছে আলকাতরার মত অন্ধকার। ইচ্ছে ছিল, পরীক্ষাবাদ বন্ধে বাসায় যাব। মুহাম্মদপুরের হাওয়ায় টুপ করে চোখ নিভিয়ে নিব। হঠাৎ উত্তরের বাতাসের মতন করে এই ভ্রমণের সংবাদ পাই – ‘সিলেট যাব ‘। খানিক আশার জমিনে খরা নামলেও ভীষণ খুশিতে তড়পিয়ে ওঠে মন। শেষ তক কোথাও চোখ মেলার সুযোগ মিলবে। উত্তরা থেকে শহরের ইটপাথরের দালানগুলো ভালোই দেখা যায়। তা দেখতে দেখতে একসময় গ্রামের সবুজ শ্যমল তরুর দেখা পাই। পাশে দিগন্তজোড়া হাওড়, সবুজ গালিচার মতন বিছানো ঘাস ক্ষেত, আর গ্রামীণ সজীব প্রকৃতির মাঝে ট্রেন চলতে থাকে। ঝুপ করে বাঁশবনের ওপাশে ডানা ঝাপ্টায় সন্ধ্যা। ততক্ষণে শায়েস্তাগঞ্জ পার হয়ে গিয়েছি।

ইয়ারফান কানে গুজিয়ে নাশিদ শুনছিলাম। সফরের সময় সূরের মুর্ছনায় হারিয়ে যেতে থাকি মুগ্ধতার আবেশে। হাতলে টেক লাগিয়ে লুটেপুটে নিচ্ছিলাম নাশিদের অমৃত স্বাদ। সুখের মধু। বিপত্তিটা ঘটলো আরেক জায়গা। শার্ট প্যন্ট পরিহিত এক ভদ্রলোকের শব্দে মনোযোগে ছেদ ঘটে

হাতলে বসতে দিবেন?
পাশে লেখা ছিল ‘সিটের হাতলে বসবেন না ‘ ইশারা তা দেখাতেই উল্টো জবাবে কি বলেছেন মনে নেই। তবে ভালো কিছু বলেছে বলে মনে হয়নি

পাশে কিছু যাত্রী দাঁড়ানো ছিল। ভেবেছিলাম খানিক বাদেই নেমে যাবে। তারা অনেকদূর গিয়েই নামছেনা। বে পেঁচামুখো হয়ে সামনে এগিয়ে গেলেন। খানিদবাদেই সে যাত্রীকে অপরজনের হাতলে বসে থাকতে দেখে কিছুটা আফসোস আর দুঃখবোধ হয়েছে।
পাশ ফিরেই দেখি ফসলের ক্ষেত আর হাওরের টলমলে জল। তাতে ফকফকা ভাসছে আকাশ। একটু ফটো তোলার আগ্রহ জাগলো। ভাবলুম, থাক না। কিন্তু অতি পরিতাপের বিষয়, এই দরবেশী বেশিক্ষণ টেকেনি। ছবি তুলে যেন ভেতরাত্মা শান্তি পেল। আমরা গন্তব্যের পথে ছুটছি। জেলার পর জেলা। ষ্টেশনের পর ষ্টেশন ছেড়ে এগিয়ে যাচ্ছি। ততক্ষণে মাগরিবের ওয়াক্ত হয়ে এলো। কম্পমান শরীর ঠেলে এগুচ্ছি। বগি থেকে বগি পার হচ্ছি। আশা হারিয়ে যাচ্ছে পাব কী না! ক্ষণকাল বাদেই ভেসে ওঠলো দোলায়মান নামাজের কামরা। ত্বহারাত সেরে ঢুকলুম মাত্র — এমনি সাধারণ মানুষজন মাওলানা সাব ভেবে আগায়া দিছে ইমামতি করতে। তাকবির পড়ে কেরাত আরম্ভ করেছি। ট্রেনের ঝাকানিতে এক পা সামনে আরেক পা পিছনে। মনে হচ্ছে, শৈশবকালীন কোন খেলা মেতে আছি। এর প্রভাব পড়েছে কন্ঠের উপরও। কুয়াশার মতো কাঁপাকাঁপা সুর আসছিল। রুকু, ক্বেয়াম তো টেকাই মুশকিল ঠাহর হচ্ছিল। স্মৃতির ডানায় অমর থাকবে এই নয়া অভিজ্ঞতা। কোনোমতে সালাতটা পড়েই মুক্তি মিললো এক দুঃসময় থেকে। আকাশ জুড়ে তখন কেবল সন্ধ্যার আঁধার নামেনি কেবল — বরং পুরোটাই ছেয়ে গেছে মেঘের কালো আবরণে। ট্রেনের দরজায় দাড়িয়েছি। হিমেল বাতাসের তোড়ে শীত শীত অনুভূত হচ্ছিল। পশলা পশলা বৃষ্টি ছুঁয়ে যাচ্ছিল ট্রেনের দুয়ার। আর বাতাসে মনমতানো ঘ্রাণ। আহা কী দারুণ। ট্রেন জার্নিতে বেশী মনকাড়া বিষয় ছিল, ফিনিক ঝরা চাঁদ। যেন খেজুর রসের শিন্নিভর্তি থালা। মেঘমুক্ত আকাশ বেয়ে বেয়ে আছড়ে পড়ছিল ট্রেনের মাথায়। নাফিস নামক এক যুবক ছিল আমাদের সফরসঙ্গী। একে ক্যমেরা বন্দি করতে না পারার আক্ষেপ বার কয়েক প্রকাশ করেছেন বেচারা। শুধু একটি ভালো ক্যমরার অভাব। আহা! কি দুঃখ! তাহার সান্ত্বনা নাইরে। সময় গড়াতে গড়াতে নয়টায় আমরা নামি কদমতলী রেলস্টেশনে। বের হতেই একটা সাইনবোর্ড দেখে খুবই আপ্লুত হলাম — ৩৬০ আওলিয়ার পূণ্যভূমি, চা রাজধানী সিলেটে স্বাগতম। কদমতলী হতে সি এন জি নিয়ে চলে এলাম বন্দর বাজার। মাঝে একটি সেতু পড়লো। এখানটায় ওঠতেই চোখ পড়লো সিলেট শহরের প্রতি। আড়ম্বরপূর্ণ উঁচু দালানকোঠায়, রাতের আঁধারে নদীতে প্রতিবিম্বিত আলোয় পুরো শহরের ভেসে যাচ্ছিল যেন।দূরে বিলাসবহুল বাড়িও চোখে পড়ছিল। এরই মাঝে শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। ল্যম্পোস্টের সাদাটে আলোর মাঝে অনবরত বর্ষনের যে চিত্রপট রচিত হয়েছিল — তা হৃদয়ের বারান্দায় ঝুলিয়ে রাখার মতন। সি এন জি থেকে নেমে আমরা খানিকটা জিরিয়ে নেই যাত্রীছাউনীতে। অপর পার্শ্বে বিশাল মার্কেট। মসজিদ। আরো কিছু গুরত্বপূর্ণ কার্যালয়। বৃষ্টি সামান্য কমতেই মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করি। মসজিদের অজুখানা হাউজ। তবে ত্বহারাত হাসিল করতে গিয়ে বেশ অবাক হয়েছি – হাউজের জল বেশ হলদেটে। আয়রনযুক্ত। তবু কি আর করা। বাধ্য হয়ে ওজু সেরে রহমানের দুয়ারে হাজিরা দিলাম। এখান থেকে পথ ধরব শিব্বির ভাইয়ের ভগ্নিপতির মাদ্রাসায়। শিব্বির ভাই হলেন নাফিস ভাইয়াদের সহপাঠী। দাওরার চারজন আর আমি সহ মোট পাঁচ সফরসাথী আমরা। একটু হেঁটে উঠে গেলাম সি এন জি। সি এন জি ড্রাইভারটা বেশ ভালো গল্পপ্রেমী ছিল। নানান স্বাদের মজাদার গল্পবলনে তার জুড়ি মেলা ভার। একের পর এক বয়ানে দারুণ দক্ষতার কারুকাজ দেখাচ্ছিল। সিলেট শহর ছেড়ে উপশহরের দিকে এগুচ্ছি। সি এন জির ড্রাইভার আমাদের নিয়ে একেক স্থান অতিক্রম করছেন, আর নির্দ্বিধ বলে চলছেন তার ইতিহাস। যদিও বিস্ময়ের বিষয় -তার ইতিহাসে দুজন ভাইয়ের ভূমিকা আছেই। বেশ উত্তম রসিকতাপূর্ণ সময়।আধা দিনের ক্লান্তিরা তখন জেঁকে বসেছিল আমাদের উপর। পেছনের তিনজন ঘুমের আতিশয্যে ঢলে পড়তে থাকি। পরীক্ষা, রাতজাগা হাড়ভাঙ্গা মেহনত, মুজাহাদার পরপর সফর, সবকিছুর ক্লান্তি শ্রান্তিতে নেতিয়ে পড়ছিল শরীর। মাদ্রাসায় উঠতে পরম যতনে অভিবাদন জানালেন খাদেম সাহেব। খাদেম সাহেবের গভীর আন্তরিকতায়, আন্তরিক খেদমাত উপভোগ করেছি পুরোটা সফর।পৌঁছুলাম মাদ্রাসায়। দেয়া হলো হলদে পানীয় কেউ একে ম্যরেন্ডাও বলে। খানিকবাদে দস্তরখানে হাজির হলো মনোমুগ্ধকর খাবার। ক্ষুধার ঘোড়াদৌড় খুব বেশি তেজি না হলেও তেজটা ধীরে ধীরে বেড়ে চলছে। অগত্যা তারে থামাতে ভোজনপর্ব সেরে নিলুম। সেদিন মূল মেজবান ঘরে ছিলেন না। তাই আমরা খানিকটা সময় গল্প পেতে বসলাম জামেয়ার আরেক শিক্ষকের সাথে। শিক্ষকরা জাতির জন্য আত্নার মতো, তারা ভঙ্গুর জাতিকে বলিয়ান করেন, নৈতিক অবক্ষয়ের উপশম করেন নিভৃতে। এ মহান পেশার সাথে জড়িত কাউরে দেখলে আমার মুআনাকা করতে মন চায়। তার মিশন নিয়ে জানতে মন চায়। সেদিনের গল্পে ভাটা পড়েছিল। তারে দীর্ঘ না করে আমরা ডুবে যাই ঘুমের আবেশে।

২|

গল্পেরা ডানা মেলে এখানে
১২ ই অক্টোবর ২০২২
বুধ

সফরের মুল পর্বটা শুরু হয় কুমারগাও স্টেশন থেকে। প্রায় দেড়ঘন্টার জার্নির পর দেখা মিলে সুনামগঞ্জ জেলার আদিগন্ত খোলা প্রান্তর, মাঝে কিছুটা সবুজ আগাছা। মেঘলা সকাল। পথের দুপাশের মায়া জড়িয়ে ছুটছি পাহাড়বিলাসের উদ্দেশ্যে। গ্রামীণ আবহের ভেতর দিয়ে সেখানটায় পৌঁছাতে প্রায় সকাল সাড়ে দশটার মত বাজে। গাড়ি যতই স্পটের নিকটবর্তী হচ্ছিল – গাছের পাতার ফাঁক গলে চোখ পড়ছিল রূপবতী পাহাড়ের দিকে। গাড়ি থেকে নেমেই মনে হলো, যেন এসে পড়েছি কোন অজানা জায়গায়। সম্মুখে তার বিশাল ঘাস গালিচাবিছানো মাঠ, শিম গাছের ক্ষেত। দূরে সটান দাঁড়িয়ে আছে সবুজাভ বিশালাকার পর্বতশ্রেণী। চাইলে আঁখিদ্বয় নামানো দায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তখন সুনীলদার মতন আমিও বলতে চেয়েছি যে আকুতিভরে—

অনেকদিন থেকেই আমার একটা পাহাড় কেনার শখ। কিন্তু পাহাড় কে বিক্রি করে তা জানি না। যদি তার দেখা পেতাম, দামের জন্য আটকাতো না। আমার নিজস্ব একটা নদী আছে, সেটা দিয়ে দিতাম পাহাড়টার বদলে। কে না জানে, পাহাড়ের চেয়ে নদীর দামই বেশী। পাহাড় স্থাণু, নদী বহমান। তবু আমি নদীর বদলে পাহাড়টাই কিনতাম। কারণ, আমি ঠকতে চাই।

পাহাড় অমনো বিহ্বল করে তোলে আমায়। আমি বিমুগ্ধনয়নে নিকর্টবর্তী হই। কাছাকাছি যাই তার। মাঝে পড়ে থাকে শিশুঘাস, লাল গরু আর দূরে ভারতের বর্ডার। সিলেটের সবচে দুঃখবহ হাকিকত হলো, পাহাড়গুলো সব প্রতীবেশীদের দখলে। এ বেদনা কুরে কুরে খেয়েছে পুরো ভ্রমনের সময়গুলোতে। যখনি পাহাড়ের মুখোমুখি হতাম, কি বিভৎস রকমের বোবাকান্নার নীরবতা যেন কানে ভেসে আসতো। আমরা সেই পরাভুত পাহাড়ের চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে চোখ শীতল করলাম বৈকি। তবে ব্যপারটা ঘটে গেল কবি হেলাল হাফিজের কথার মতন ‘যে জলে আগুন জ্বলে ‘।

এখানের বাঁশবাগানের বাতাসের তিরতির করে কাঁপা চিকনপাতার বন মাড়িয়ে সামনে এগুলেই কিছু স্থানীয় মানুষ পরম যত্নে পরিচিত হোন। কিছুটা দুর পর্যন্ত ঘুরাতে নিয়ে যান। বর্ডারের তীরসীমানার কাছে এসে তিনি আফসোসের স্বরে বলেন
— সামনে যে মাঠখান দেখতাসেন, ছোটকালে আমরা এখানে নিয়মিত খেলতাম।

তার কথায় হাহাকার ফুটে ওঠে। সে সূচালো হাহাকার, বিরহ বিদ্ধ করে বুক।

এ মায়াময়তা ছেড়ে ফের শুরু হয় নতুনের পথে যাত্রা, যাদুকাটা নদী পার হয়ে অটোরিকশা করে সোজা শিমুল বাগান। এখন শিমুল ফুলের সিজন না। বরং নতুন কিশলয়ে সবুজের আভা জড়িয়ে থাকা পুরো বাগান জুড়ে। তবে ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ যেতেই হবে। মাঝপথে সিলেটের স্থানীয় একজন পথভাড়ায় সহায়তা করেন কিছুটা। সিলেট চলার পথে পথে তাই আমার বিপুল বিস্ময়। এখানকার মানুষজন এতটাই সহায়তায় উদার, অবাক হতে হয়। বাগানে এসে পৌঁছুলুম দুপুর দুইটার দিকে। শিমুলগাছের সবুজ দৃশ্য আর পাশ দিয়ে বয়ে চলা খসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় চিরে বয়ে যাওয়া জলের যাদুকাটা নদী ও মাটির মিলনে যেন আবির্ভাব ঘটেছে এক সুন্দর দৃশ্যের। নদীটা জমিন থেকে অনেকটা নিম্নমুখী। বা বাগানটা কিছুটা উঁচু। এখানে বসে দুপুরের নাস্তা সেরে নেই। নামাজটা পড়ে সেখান থেকে বের হতে গিয়ে চালকের সাথে ঝামেলা বাঁধে বাগানের কর্মচারিদের। কথা-কাটাকাটি আর কি। ঝগড়া থামিয়ে ফের পথ ধরি নতুন গন্তব্যের, নীলাদ্রি। সিলেটের সবচে মনোহর জায়গা। একপাশে দূর পর্বতে হিমালয়ের মেঘরাশি, নীলচে জলে পড়ছে সে শুভ্রহরিৎ মেঘের প্রতিছায়া। পানিতে নামলে মনে হয় যেন ছুয়ে ফেলছি মেঘদল। হঠাৎ করে এসে পড়েছি কোন স্বর্গরাজ্যে নিলাদ্রি পাঁ রেখে দেখলাম, পাহাড়ের অনেকটা উচ্চতায় একঝাক নীল পাঞ্জাবি ছেলে তেলাওয়াত করছে, গজল গাইছে। বাতাসে তাদের কণ্ঠ ভেসে আসছে। তাদের পাশ কাটিয়ে মোড় নিতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠলো নীলাদ্রির অপূর্ব রুপ সৌন্দর্য। এর প্রকৃত নাম শহীদ সিরাজ লেক। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অত্রাঞ্চলীয় এক কমাণ্ডার পাকিস্তানি হানাদার কর্তৃক নিহত হলে তাকে এখানে কবর দেয়া হয়। সেই থেকে এ নামের উৎপত্তি। তবে পর্যটকদের কাছে ‘নীলাদ্রি লেক’ নামটা জায়গা করে নিয়েছে। এর নীল জলরাশি, মাঝারি সাইজের টিলা আর সুদূরের মেঘালয়ের অভূতপূর্ব সম্মিলনে এক আশ্চর্য সুন্দরের অবতারনা ঘটে। এ প্রকৃতির কাছে সামান্য তাসবীর ( ফটো) তুলে আমরা এগিয়ে যাই নীলের কাছে, সবুজের বুকে। লেকের মাঝে নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে একটি গাছ। আর তার নিচে আঁকড়ে ধরার মতন একচিলতে মাটি। পাঞ্জাবিখানা রেখে নেমে পড়ি লেকে। আখিদ্বয় বন্ধ করে ডুব দেই তার অতলে। মাথা তুলতেই দেখি মেঘ ডাকে সারি সারি নিরালায় নিশ্চুপ। সাতরে লেকের ওপাশে পৌঁছে গেছে বড়ভাই সাব্বির, আব্দুর রহমান। নাফিজ ভাই সাতরে যেতে না পারলেও উনার আফসোসটা ঘুচে যায়, কারন ওপাশে যাওয়ার স্থলপথ রয়েছে। আমিও তার পিঁছু পিঁছু দৌড়ে কাঁদা মাটি মাড়িয়ে সেখানে যাই। টিলায় উঠে আবার দেখি তার অবর্ণনীয় রূপ – সৌন্দর্য। এখানে সময়টা শেষে হয়ে আসে। বিকেলের আলো মিইয়ে হাতির চামড়ার মতন আঁধার নেমে আসে। ধীরে ধীরে ফের সিলেটের পথ ধরি। বিপত্তিটা ঘটে এখানেই পাহাড় থেকে নামতে না নামতেই পাঁয়ের রগটানা শুরু হয়। আগেও এমনটা বহুবার হলে খানিকটা হাঁটলে স্বাভাবিক হয়ে আসে। কিন্তু এবার বেলা গড়িয়ে অস্বাভাবিক হচ্ছে। ব্যথার অসহনীয় যন্ত্রনায় কাতরে ওঠি। বসে পড়ি নিজের অজান্তেই। চারপাশে লোকজনের ভীড় জমে। কেউ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে বলে, কেউ ঠান্ডা পানি খাওয়াতে বলে। সফরসঙ্গী কোন বড় ভাই পাঁটা সামান্য মলে দিলে ব্যথাটা কমে আসে, তবু শেষ হলেও রেশ রয়ে যায়। এ নিয়ে বেশ ঝাক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়। কোনমতে অটোর পেছন সিটে বসে যাত্রা শুরু হয়। এ ব্যথার কারণে পেছনের সিটে বসা নিয়ে যে পালাক্রম চলছিল, পুরে সফরে আমি তার বাইরে ছিলাম। সবাই সামনে বসতো, কিন্তু কেউ আমাকে বসতে দিতো না বা বলতো না। পথিমধ্যে পড়ে বারিকাটিলা। এ টিলাটা দেখে আদৌ মনে হবে না, এর এতো নাম যশ। যদিও অস্বীকার করার জো নেই টিলাটা সুন্দর। পথ থেকে বেশ উঁচুতে এ টিলায় উঠতে হলে উর্ধ্বমুখি পথে হাঁটতে হয়। সন্ধ্যের আলো আঁধারিতে সেখান থেকে ভারতের পাহাড়গুলো দেখা যাচ্ছিল আবছা আবছা। সে পথ ছেড়ে ধীরে ধীরে যাদুকাটা নদী পার হয়ে নামি সুনামগঞ্জ। সেখান থেকে সিলেট শহরে। এবার এসে মেজবানের দেখা পাই। শিব্বির ভাইয়ের ভগ্নিপতির কথা আগেই বলেছিলাম। মধ্যবয়স্ক, খানিকটা স্ফিত শরীর,চুলে বার্ধক্যের শুভ্রতা ছড়িয়ে আছে কাশফুলের মতন। তিনি জামেয়ার শিক্ষাসচিব। পড়াশোনা করেছেন ঐতিহ্যবাহি দেওবন্দ দারুল উলুমে। মাদ্রাসায় ‘দেওবন্দি’ হুজুর নামে তার বেশ নাম ডাক। সহাস্যে আমাদের কাছে ডেকে হালপুরসী করলেন। সফরের অবস্থাদি সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলেন। এতক্ষণ ভবনের নিচে ছিলাম। তিনি উপরে নিয়ে মেহমানদারি করালেন। চিংড়ি, মুরগী আরো আড়ম্বরপূর্ণ খাবার দাবারে ক্ষুধার ইঁদুরটা থামলো কিছুক্ষণের জন্য। এরপর হালকা গল্পের মজমা জমতে শুরু করে। নাযেম সাহেব টঙের দোকানে নিয়ে দুধচা পিয়ালেন। কিন্তু আমাদের ক্লান্তির রেশে মজমা আর বেশি গাঢ় হতে হয়নি।

৩|

মায়াবী ঝর্নার কলতান
১৩ ই অক্টোবর ২০২২
বৃহঃ

ফজর নামাজ পড়ে বের হতেই দেখি ধীরলয়ে আলো ফুটতে শুরু করেছে। মৃদুমন্দ বাতাস গায়ে মেখে খানিকটা পথ মাড়িয়ে দেখি — আমাদের জন্য চা বিস্কিট নিয়ে এসেছেন নাযেম সাহেবের খাদেম। দুদিনের জন্য সিএজি একখান ভাড়া করেছিলাম। আসতে দেরী হবে ভেবে নাস্তারও ব্যবস্থা করে ফেলেন তিনি। অগত্যা নাস্তা করে তিনচাকার যানে উঠে রওনা দিই। আমাদের সাথে আজকের সফরসঙ্গী মাদ্রাসার এক তালিবুল ইলম। শিব্বির। নাযিম সাহেব সাথে দিলেন। চিকনগড়নের এ বৎসকে দেখলে মনে হয় আমার এক চাচার কথা। ইসমাইল চাচা। ছেলেবেলায় আমার বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে মন্দিরের সামনে শিমুল তলায় আমি দাঁড়িয়ে থাকতাম। তিনি সাইকেল দিয়ে আমায় মাদ্রাসায় নিয়ে যেতেন। ব্যপারটা শুনতে সুখকর হলেও বাজারের জনৈক পানদোকানদারের জন্য তা আর সুখকর রইল না। বুড়োচাচা আমাকে চেতিয়ে বেশ মজা লুটতেন আর চাচ্চু হাসতেন মিটিমিটি। আমরা একি মাদ্রাসায় ছিলাম। উনি শিক্ষক আর আমি ছাত্র। একটুকুন স্মৃতিই তার সাথে আমার। নবাগত এ সঙ্গীকে হুবুহু ইসমাইল চাচার একখান কপি বোধ হলো। এটা কেবল আমার কথা না। অন্যদেরও এতে সম্মতি আছে। সে আমাদের পথপ্রদর্শক আজ। যাত্রাপথে পানিজমা বিশাল ক্ষেত ফেলে আমরা এগুতে এগুতে একটা সময় পাহাড় দৃষ্টিতে আছে। সিলেটের একটা অঞ্চলের যেখানেই থাকি, দূর হতে পাহাড় তাকিয়ে থাকে। যেতে যেতে এক সময় পথ ঘেষে পাহাড় দৃষ্টিতে আসে। কোন পাহাড়ের বুক চিরে বইছে বিহদাকার ঝরনা। কোনটায় ছোট ঝর্ণা। ভাবালু দৃশ্য দেখতে দেখতে কিছুক্ষণ পর থামলাম এক ছোট টিলার পাশে। যেখানে ফাঁকা করে লাগিয়ে রাখা হয়েছে চা-বৃক্ষ। এটাকে পাহাড়ি চা বাগান বলা যায়। সকালের সূর্য সবে মাত্র হলদে থেকে সাদা হয়েছে। স্বচ্ছ রোদ পড়ছে গায়ে। ফের শুরু হয়যাত্রা । গন্তব্য জাফলং। কিছুটা উঁচু রাস্তায় উঠে গাড়ি রেখে সিড়ি ভেঙে অনেকটা নিচে নামতে হয়। নিচে নদীর মতন একটা জলাশয় পড়ে। তা পাশ কাটিয়ে সামনে যেতে ছোট মাঝারি পাথরের সম্মেলনের দেখা মিলে। বর্ষাকালে ভারতীয় সীমান্তবর্তী শিলং মালভূমির পাহাড়গুলোতে ভারি বৃষ্টিপাতের ফলে পাহাড় থেকে ডাউকি নদীর উতলা স্রোত বয়ে আনে বড় বড় গণ্ডশিলা। এজন্য এ জাফলং শ্রমিকদের উপজীবিকার মাধ্যমও বটে। খসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় আর ডাউকি নদীর অপূর্ব সমন্বয়ে দৃষ্টি কাড়ে ভ্রমনপিয়াসুর। এখানটায় আসলে ভাসে দূরে একটা ব্রীজ। একসময় আমি ভাবতাম, এটা বাংলাদেশের অংশ। আর এ পথ ধরেই যেতে হয় জাফলং। কিন্তু ধারনা পাল্টাতে দেরি হয়নি। বাস্তবতা হলো, জাফলং আমাকে তার খ্যতির মত টানেনি। যেন এক আকাশ প্রত্যাশায় এতটুক প্রাপ্তি। সেখান থেকে ট্রলার ভাড়া করে ডাউকি নদীর ওপাশে গেলেই মায়াবী ঝর্ণা। ছয় সফরসঙ্গী মিলে বানরের চঞ্চলতায় ওঠে পড়লুম। অমনিই দেখি হাল জমানার ফ্যশনেবল পোশাকজড়ানো গাত্রপ্রদর্শনী দুই তরুণী চেপে বসেছে আমাদের সাথে। আব্দুর রহমান ভাই দাঁড়িয়েছিলেন,

একজন তরুণ আবেদনের স্বরে বললেন —

-আপু একটু চেপে বসুন
-কেন চেপে বসবো? আমরা কি ভাড়া দিইনি?

তরুণীর এমন ঝাঁঝালো জবাবে চুপসে যায় তরুণ। আমরা কিছু না বলে শুধু হা করে অবস্থা দেখি। নিশ্চুপ ডাউকি নদী চিরে নৌকা নোঙর করে মরুভূমির মতো বালুকাময় প্রান্তরে। তখন দুপুরের তালপাকানো ঝাঁঝাঁ রোদ। পুড়ে যাচ্ছে মানবকুল আর বৃক্ষরাজীর কোমল দেহ। দূরে মৃদুমন্দ বাতাসে দুলছে কাশফুল। এর পাশে একটা কুলবরই গাছ। এখানে মায়াবতি ঝর্নার কলতান শুনি৷ দু কদম গেলেই কাশবন। এক অজানা টানে কিবা আকর্ষণে ঝরনা পেরিয়ে সেখানে গেলাম। আকাশটা খানিকটা নীল, আর তার বুকে দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে মেঘরাশি। গনগনে রোদ। আমরা যেখানটায় দাঁড়িয়ে আছি, এর অপরদিকে লম্বা নারকেল গাছের বাগান। যাওয়ার পথে পাঁয়ে সমান জলের নালা পার হতে হয়। একটা মরা গরু পড়ে থাকতে দেখে নাফিস ভাইয়া ভিডিও করা শুরু করলেন। পুরো সফরের প্রায় স্মৃতি তিনি সংরক্ষণ করেছেন। তার ধারণা মতে, প্রতিবেশী দেশ থেকে এ গরু পাচার করতে গিয়ে ইন্তেকাল করেছে। নাফিস ভাইয়াদেরও শখ জেগেছে ঝর্ণায় শরীর ভেজাবেন। কিন্তু ঝর্ণা সেকি করুণ অবস্থা। নারী পুরুষের সম্মিলিত চিৎকারে ভারি হয়ে ওঠছিল প্রকৃতি। অবাধ স্বাধীনতার সুর তুলে নারীরাও সমানতালে নেমেছেন গা ভেজাতে। মধ্যাহ্নের এ তপ্তবেলায় ফ্রিমিক্সিয়ের প্রভাবে এক বর্ণনাতীত দৃষ্টিকটু পরিবেশ তৈয়ার হচ্ছিল। আমি অক্ষম আক্রোশে ফেটে পড়ি। বারবার বলা সত্ত্বেও এখানে যেতে বিবেক বাঁধে। তারা নাছোড়বান্দার মতন পাহাড়ি ঝর্ণায় উঠেন, পাহাড়ের বেশ উঁচুতে উঠে গর্বের সাথে মুখাবয়ব প্রকাশ করেন। আমি গোবেচারা নিচে ঠায় দাড়িয়ে তাদের কীর্তিকালাপ দেখছিলাম। বেশ বিরক্তবোধও হয়েছিল। থেকে থেকে গল্প জুড়ে দেয় নতুন সফরসঙ্গীর সাথে। উনি নাযিম সাহেবর মাদ্রাসার তাকমিলের তালিবুল ইলম। মাটির মানুষ । নাফিস ভাইয়া এ উপাধি দেন। বেশ মিশুকমনা। ঝর্ণার সামনে কয়েকটি অস্থায়ী দোকানপাট। ভারতের বর্ডার থেকে আমদানিকৃত নানা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন তারা। চকলেট, সুগন্ধা সাবান সুলভ মূল্যে বিক্রি করেন বলে এদের দাবি। ফলত সমাদরও জুটে ভালো কিসিমের। এমন এক দোকানের পেছনের দিকে বাড়ন্ত তাবুর ছায়ায় তাকে আমি প্রশ্ন করি

আমাদের মেজবান হুজুরকে আপনারা কি ডাকেন?

দেওবন্দি হুজুর। মূলত আমাদের মুহতামিম সাহেব ছিলেন দেওবন্দ পড়ুয়া। তাকে সবাই কাসেমি ডাকত। দুই কাসেমি একসাথ হয়ে যাওয়ায় নবাগত হুজুরকে ‘দেওবন্দি’ নামেই ডাকা শুরু হয়।

এভাবে কথার পিঠে কথা ছুড়ে সময় যায়। বেলা গড়ায়। তাদের আর ঝরনা থেকে নামার কথা মনে থাকে না। বেশ সময় পার হলে নেমে এসে মুচকি হেসে আমাদের বিরক্তি ব্যপারটা উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন তারা। কিন্তু সে উপায় কই। জামা কাপড় পাল্টে আমরা সে দোকানে যাই। একটা আঁচার দেখে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। মনে ভাসে, ছেলে বেলা আমার চাচা গিয়েছিলেন সেন্টমার্টিন। সেকালে তার নাম যশ এতোটা জানা ছিল না। ফিরতি পথে চট্টগ্রাম থেকে বাড়ির জন্য এ ব্র্যান্ডের চকলেট নিয়ে আসেন। বাসায় তেমন কেউ নেই, তবু আমি শখের বশে দুধরনের আঁচার কিনি। আব্দুর রহমান ভাই কিনেন
অনেকগুলো সাবান। ঘরের বড় ছেলে। ঘরের সদস্যদের হাদিয়া দেওয়ার তার অদম্য বাসনা। দোকানপাটের অংশটুক ছেড়ে নদীর কাছাকাছি আসতেই দেখা যায় কিছু হোটেল। সাইনবোর্ডহীন। চারপাশে নীল হলুদ কাপড়মোড়ানো। দুপুরের ভোজটা এ বেনামী ভোজনালয়ে সেরে আমরা নদী পার হই। পাথর মাড়িয়ে উঠি মুল সড়কে। মাঝে হরেক রকমের খাবারের দেখা মিলে। ভোজনের তীব্র বাসনা সত্ত্বেও নিজেকে দমিয়ে রাখতে হয়। সিএনজিতে উঠে নাফিস ভাই পানের কথা তোলেন। শিব্বির ভাইও পানখোরের দলভুক্ত। তারা পান খাওয়া নিয়া চুক্তি করে। দুপুর গড়িয়ে নামছিল বিকেল। ক্লান্তিতে নুয়ে আসছিল শরীরখানা। ঘুমের আতিশয্যে বারবার ঢলে পড়ছিলাম। আর জেগে উঠছিলাম। জেগে লজ্জায় তাকাতে যাব, দেখি সবার হালাত একি।

যেন কেউ ঘুমপাড়ানি ছন্দ কাটছে, আর জপছে—
কোন ক্লান্তিরা আজ নেমেছে এ বাহনে,কেন বেঁধেছে নীড়?

আমরা যাচ্ছি লালাখালের উদ্দেশ্য। এর নীলচে পানি দর্শককে বিমোহিত করে – এমন খবর তার ব্যপারে মশহুর আছে। পৌঁছেই আসরের নামাজ পড়ি উঁচু মাটির ঢিবির পাশে এক ভঙ্গুর মসজিদে। ইমাম সাহেব গ্রাম্য মাদ্রাসায় অধ্যয়নরত। এসে হাত বাড়ালেন। মুসাফাহা করলেন। কথাবার্তা জিজ্ঞেস করলেন। নামাজখানা পড়ে আমরা লালদীঘি দর্শনে বের হই। কিন্তু মনোবেদনার ব্যাপার হলো, দীর্ঘ বৃষ্টিতে পানির রঙে পরিবর্তন এসে পড়েছে। খানিকটা লাল সবুজ। তাই নীল জলরাশি দেখার ভাগ্য হলো না। পাশে টিলাগুলোর বেশ উঁচু। দেখলে ছোটখাট পাহাড় বলে ভ্রম হবে। উঠতে উঠতে সটান মাথা উঁচিয়ে দাঁড়ানো সুপারি গাছ। একবারে উপরে এ বাগানের মালিকের বাসা। নিচেই মালিকের দেখা পেলুম। একটা নৌকা বানাতে ব্যস্ত তিনি। আমরা উপরে উঠার অনুমতি চেয়ে তবেই উঠেছি। বাগানের ফাঁক ফোকরে আনারস গাছও দেখা যাচ্ছিল। বিকেলের ক্রমশ রক্তিম হওয়া আলোয় সবুজের মাঝে এক ঐশ্বরিক আলো লুটোপুটো খাচ্ছিলো। বাড়িটা একপাশে, সদর মুখে আধখানা পর্দা দেয়া। পাশেই তাকালে দেখা যায় — নিচে বেশখানেকটা দূরে একটা দুতলা বাড়ি। এখানে বেশ সময় কাটিয়ে নিচে নেমে লালাখালের এক পাকাঘাটে বসে পড়ি বিকেলযাপনে। ধীরে ধীরে বিকেল ফুরিয়ে আসে। নিভে আসে ক্ষয়িষ্ণু আলো। পুকুরের সিড়ি পেরিয়ে সিএনজিতে উঠতে উঠতে সন্ধ্যা নেমে গেছে প্রকৃতির গা জুড়ে। পাহাড়ঘেঁষা পিচঢালা পথে। এবারের গন্তব্য গ্যাস উত্তোলন কেন্দ্রে। এখান থেকে গ্যাস তোলা হয় কী না তা জানা নেই। তবে বেশকিছু মুগ্ধকর। সেখানে পোঁছুতে প্রায় আঁধারের গেড়ে বসেছে চারপাশে। আকাশটা নীলাক্ত দেখাচ্ছে। গ্যাসের প্রভাবে এখানটার মাটি, পাশের উচু মাটির ঢিবিতে ম্যাচের কাঠি দিয়ে আগুন ছাড়লে তা ছড়িয়ে পড়ে। গাছে পাতা দিয়ে সে আগুন নেভানোও যায়। দর্শনার্থীরা আসলে এ খেলায় মেতে উঠে দারুণভাবে।

এখান থেকে কিছুরদূর সিএনজিতে গিয়ে ঢুকে পড়ি এক জমজমাট গ্রাম্যবাজারে। দশটাকার খিচুড়ি নামে এক বিখ্যাত খাবার পাওয়া যায় এখানে। যদিও বিশ টাকা দাম চুকিয়েই খেতে হয়েছে আমাদের। এক প্লেট খিচুড়ি। উপরে একচামচ ছোলাভাজা ছিটিয়ে দেয়া সামন্য শসাকুচি আর পেয়াজ।

৪.

দুয়ারে এসেছে বিদায়
১৪ অক্টোবর ২০২২
শুক্রবার

আজ সফরের শেষ দিন। সূর্য তখনো মাথা জাগায়নি। চারদিকে আলো আঁধারি। ফজরের পর যেন ছড়িয়ে পড়ছে রহমতের মৃদুমন্দ বাতাস। আর প্রাকৃতির শীতল মাটির ঘ্রাণ। সিলেট নগরী পেরুলেই লক্কাতুর চা বাগান। বাংলাদেশের প্রথম চা বাগান বাগানের মাঝ দিয়ে, স্টেডিয়াম পেছনে ফেলে যাচ্ছি সাদা পাথরের উদ্দেশ্যে। একটু সামনে এগুলেই দেখা যায় সিলেট বিমানবন্দর।
ঝাপসা কুয়াশা জড়িয়ে আছে চারপাশে। সমস্ত প্রকৃতি জুড়ে। সাদা পাথরের দূরত্ব ৩৫ কিলোমিটার । কোম্পানীগঞ্জের টুকের বাজার পৌছুতে অনেক বেলা গড়িয়ে গেল। আকাশে তখন গনগনে সূর্য। সকালের নাস্তা না করেই সেখান থেকে ট্রলার ভোলাগঞ্জ জিরো পয়েন্ট সংলগ্ন সাদা পাথর পর্যটন স্পট।

ভারত থেকে নেমে আসা সীমান্ত নদী ধলাই নদীর জিরো পয়েন্টই এলাকা স্থানীয়ভাবে ‘সাদা পাথর’ এলাকা হিসেবে পরিচিত।

আকাবাকা নদীর ওপারে সুবিশাল পাহাড়। সবুজের সমারোহ। আর পাহাড়ের সাথে মেঘের গলাগলি। নদীর জলে ভাসছে স্বচ্ছ আকাশ। সে কী দারুণ দৃশ্য। সুবহানাল্লাহ।

মূল স্পটে পৌঁছে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। যত দূর চোখ যায় –, শুধুই পাথর। কিছুদূর শুকনো পাথর। সামনেই ধলাই নদীর প্রচন্ড বেগে বয়ে চলা জল। পানির কারনে পাথরগুলো বেশ পিচ্ছিল। চলতে তাই বেগ পেতে হচ্ছিল।
অবস্থা দাঁড়ালো

হাটুজল,
তবু যেন সাগর অতল।

এমনই সকরুণ অবস্থা হচ্ছিল। সে শীতল পানিতে গা ভিজিয়ে দূর পাহাড়ে তাকিয়ে থাকলাম। পাথরের উপর দিয়ে সগৌরবে ধেয়ে আসছে পানির ছোট ঢেউ। কি মায়া জড়িয়ে আছে রবের সমস্ত সৃষ্টিতে। এখানে দাপাদাপি করে দুপুরের খাবার সেরে নেই৷ খাবারে যা চওড়া দাম। অনেক মুলামুলি করে খাবার প্যকেজ মিলেছে সুলভ মূল্যে।

এবার যাত্রা রাতারগুলের উদ্দেশ্যে। মাঝপথেই জুমা পড়ে নিই গ্রামের ছোট মসজিদে। রাতারগুল। মিঠাপানির জলাবন। চিরসবুজ এ বন গোয়াইন নদীর তীরে অবস্থিত। এখানে সবচেয়ে বেশি জন্মায় করচ গাছ। বর্ষাকালে অথৈ জলে ফুটে উঠে এর রূপ সুষমা। মেঘলা দিনে, ভেজা শ্রাবণের দিনে রাতারগুল গেলে তার মোহনীয় সৌন্দর্য ধরা পড়ে। রাতারগুল নিয়ে আমার বেশ আগ্রহ ছিল। উপন্যাসে এখানকার গল্প পড়ে এ আগ্রহ জন্ম নেয়। গল্পে রাতারগুলের সন্ধ্যার এক অপূর্ব বর্ননা পড়েই আমি বিমুগ্ধ

এবার যাত্রা রাতারগুলের উদ্দেশ্যে। মাঝপথেই জুমা পড়ে নিই গ্রামের ছোট মসজিদে। রাতারগুল। মিঠাপানির জলাবন। চিরসবুজ এ বন গোয়াইন নদীর তীরে অবস্থিত। এখানে সবচেয়ে বেশি জন্মায় করচ গাছ। বর্ষাকালে অথৈ জলে ফুটে উঠে এর রূপ সুষমা। মেঘলা দিনে, ভেজা শ্রাবণের দিনে রাতারগুল গেলে তার মোহনীয় সৌন্দর্য ধরা পড়ে। রাতারগুল নিয়ে আমার বেশ আগ্রহ ছিল। উপন্যাসে এখানকার গল্প পড়ে এ আগ্রহ জন্ম নেয়। গল্পে রাতারগুলের সন্ধ্যার এক অপূর্ব বর্ননা পড়েই আমি বিমুগ্ধ হয়ে যাই। অপেক্ষা করি কবে যাব তার কাছে। রাতারগুলের দিকে অভিযাত্রা যেন প্রিয়তমের কাছে ফেরার মত আনন্দের, সুখের। দুপর তখন। আমরা পৌছুলাম। নৌকা ভাড়া করে ধীরে ধীরে হারিয়ে গেলাম বনের গহীনে। মাঝি চাচার কথা শুনে যারপরনাই মুগ্ধ হলাম। তার ছেলে সিলেটের এক নামকরা মাদরাসায় পড়ে। তিনি আমাদের প্রতি বেশ আন্তরিক ছিলেন। রোদতপ্ত দিনে গিয়ে আমি রাতারগুলকে মনের মত করে পাইনি। ঘোলা পানি, ধুলোমলিন পাতা, নেতিয়ে পড়া ডাল। ঠিকরে পড়া রোদে কেমন যেন অচেনা মনে হলো কল্পনার রাতারগুলকে।

রাতারগুল গিয়ে এক ভিনদেশি ভ্রমনার্থীদের দেখা পেলাম। তাদের সাথে দেশীয় একজন। পাশ দিয়ে এক মাঝি গলা ছেড়ে আদিকালের গজল গাচ্ছিল। আমাদের মাঝিও সুর মেলাচ্ছে। নিঝুম দুপুরে একলা বনে সে সুর প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। রাতারগুল থাকতেই বিকেল নেমে আসে। আমরা রওনা হই আমাদের শেষ ভ্রমণস্থান শাহজালালের মাজার। সাথে সিলেটের স্বনামধন্য মাদরাসা দরগাহে।
শাহজালালের মাজার নিয়ে সবার বিপুল আগ্রহ থাকে। মাজারটা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। হরেকরকম বাতি দিয়ে ঘেরা মাজার। বর্ণিল আলোয় ঝলমল করছে চারদিক। নানারকম দর্শনার্থীর ভীড় লেগে থাকে সর্বদা। ওখানে মাগরিব পড়ে মাজারে ঢু মেরে আসলাম। এরপর দরগাহে ঢুকলাম। দরগাহের সুনাম আগেও শুনেছি। উপরে উঠে শিব্বির ভাইয়ের এক সহপাঠীর সাথে কথা বললাম। সিলেটের মানুষ নিজেদের মাঝে সিলেটি ভাষায় বললেও আমাদের সাথে যথেষ্ট শুদ্ধ ভাষায় বলতে চেষ্টা করেছেন। যদিও এটাই স্বাভাবিক। আমার কাছে ভালো লেগেছে।

শেষ মুহূর্তে এসে আমাদের মনে হলো, ট্রেনের টিকেট আগেই কাটা উচিত ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সবাইকে বাসের ক্লান্তি পোহাতেই হলো। রাত দশটার টিকেট কেটে আমরা রওনা হই নাজিম সাহেবের মাদ্রাসায়। সেখানে রাতে খাবার সেরে তার কাছ থেকে বিদায় নেই। পুরো সফরে তিনি যে আন্তরিকতা, স্নেহে আমাদের জড়িয়ে রেখেছেন, তা বিরল, বর্ণাতীত। তা আমাদের বিহ্বল করে। তার থেকে, তার খাদেম থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হই বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে। বাস ছেড়ে যাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছিল, যেন আত্না ফেলে যাচ্ছি এখানে। রাতের আঁধারে বাস সিলেট ছাড়লেও মন যেন সিলেটেই রয়ে গেছে। নিষ্প্রাণ এক অবয়ব নিয়ে সিলেট ছাড়ছি। পিছুটান ফেলে ছুটি যাচ্ছি। যেতে হয় জীবনের তাগিদে। সান্ত্বনা দিই, চলে যাওয়া মানেই প্রস্থান নয়।

শেয়ার করুন

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments