কোনোএক বৃহস্পতির রৌদ্রজ্বল দুপুরে নাস্তা সারতে গিয়ে নয়া ঝকঝকা একটা সেফটিপিন খুঁজে পেলাম আমি। টিফিনটাইম শেষে সবিনায় (হেফজোখানায় বৃহস্পতিবারের জন্য নির্ধারিত পড়াশোনা) বসে আশপাশে সংবাদ ছড়ালাম ‘প্রেমিকার সেফটিপিন’ বলে। বললাম—এবার যখন বাড়ি ছেড়ে চলে আসছি তখন দিয়েছে এটা। কী এক হুলুস্থুল পড়ে গেল আমাদের গ্রুপের ভিতর। কাড়াকাড়ি করে সেফটিপিনটা যখন সালমানের হাতে, শিক্ষক সামনে হাজির। প্যারিস শহরের মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা মূর্তি ভাস্কর্যের রূপ নিয়েছি আমরা। ওয়ার্নিং আসলো— “সওয়াল না ফাইলে খবর ওইবো।” কপালক্রমে সেদিন আমরা সবাই-ই সওয়াল পারলাম। খোদা রক্ষা করলেন। খবর হলো না আর!
•
আব্দুর রহমানের সেবারের শাস্তি ছিল আট কিম্বা নয়জন ওস্তাদের সাইন সমেত পাপ মোচনের দরখাস্ত জমা দেওয়া। বলা বাহুল্য আমরা কেউই ভুলিনি তাকে। মাসখানেক ঘোরাঘুরির পর আট জনের সাইন সহ ঐতিহাসিক দরখাস্তটা জমা দিয়েছিল আব্দুর রহমান।
•
আরেকবার অভিযোগ উঠলো মিনহাজের ওপর। খানা বণ্টন করতে গিয়ে কখনো চার পিস মাছ আবার কখনোবা তিন পিস রোস্ট ভাতের নিচে করে মেরে দিচ্ছে মিনহাজ। অভিযোগটা খতিয়ে দেখার জন্য এক রাতে বোর্ডিং সুপার সচেতন হয়ে উঠলেন। প্রাথমিক অভিযান হিশাবে মিনহাজের প্লেটভর্তি ভাতে আঙুল ঢুকালেন তিনি। ভাতের তল থেকে বেরিয়ে আসলো—মাত্র তিন পিস মাছ। মিনহাজ পেয়েছিল ‘খাকি চত্বরের খোয়ারি’র মতো এক্সট্রা একটা ড্রিল।
*
এমনই কিছু গল্পের ভেতর দিয়ে সার্কাসের মতো করে ঘুরে চলেছে ‘খাকি চত্বরের খোয়ারি’। যেখানে আছে—কড়কড়ে খাকি, চকচকে বুট। ঝকঝকে বেল্ট পরে প্যারেড, পিটি আর মার্চপাস্টের ওপর দিয়ে ‘ডিসিপ্লিনড জেন্টলম্যান’ গড়ে উঠবার আকাঙ্খা নিয়ে বয়ে চলা পৌনঃপুনিক এক জীবনচক্র। আছে ‘ন্যাত্রকোনার সোবহান’; যে একদিন হয়ে উঠেছিল—খাকি চত্বরের দক্ষ স্কটিশ ব্যাগপাইপ বাজিয়ে। আছে— রুমি; পাসিং আউট প্যারেডের দিন খাকি পরার সুযোগ হারাবে সে। আছে—কসকো রাজীব, পুরো গল্পের অন্যতম স্থিরচিত্র—মিলন। আর আছি আমি।
হ্যাঁ আমিই । কারণ পাঠক যখন বইটি পড়তে শুরু করবেন তখন তিনি একজন ‘আমি’র দেখা পাবেন। দেখা পাবেন তার অতি পরিচিত এক দৃশ্যের। মনে হবে—এই খাকি চত্বর তারই জীবনগল্প। আমাদের এই চেনাজানা জীবনের গতানুগতিক দৃশ্যগুলোই অবলোকন করবো আমরা। খাকি চত্বরের নারীহীন আঙ্গিনা দেখে মনে হবে, এতো আমারই ক্যাম্পাস। যেখানে কোনো নারীর ছায়া পড়লে কেমন জানি বেজে উঠে সব। মনের ভেতর শুরু হয় অন্য এক হুলুস্থুল আর অগোছালো ভাব। যার নুপুর আর চুড়ি থেকে বেজে ওঠা অযাচিত সুর, এই নবকিশোরদের মনে থাকে আজন্মকাল। গল্পের প্রথম পৃষ্ঠা কিম্বা গল্পের মধ্যভাগের কিছু আগে আমরা আবিষ্কার করি মিলনকে। হ্যাঁ, তার আগে হাউজ মাস্টারের হাতে ধরা পড়ার ভয়ে ‘প্রেমিকা’কে ‘মা’ সম্বোধনে লেখা এক কিশোরের প্রেমপত্র পড়বেন আপনি। পড়বেন প্রেমিকার পক্ষ থেকে বাবা সম্বোধনে লেখা ঐতিহাসিক প্রেমপত্র। মিলনের কথাই বলি—গল্পের মিলনকে আপনার মনে হবে—জিন্দা এক জীবনদাশ। সে যখন বলবে—“ফুটবল মাঠে গোলকিপারের পজিশনটা বেশ অদ্ভুত। সে মাঠে আছে আবার ঠিক নাইও। মাঠের ভেতরে থেকেও সে একধরনের দর্শক। গোলপোস্টে দাঁড়িয়ে পুরো খেলাটা সে চোখের সামনে দেখতে পায়।” রহস্য করে বলে—“আমিও কিন্তু এই চত্বরে আছি ওই গোলকিপারের মতোই। তোদের সবার মধ্যে আছি আবার নাইও।” এরপর সে যখন সময়ে সময়ে জীবনানন্দ আর আবুল হাসানের জীবনমুখি কবিতাগুলো আওড়াতে থাকবে, মিলনের প্রেমে পড়ে যাবেন আপনি।
•
এমনতর দৃশ্যের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে আপনি পাবেন— শফিক স্যারের দেখা। যিনি ক্লাসে নানা প্রশ্ন তুলবেন। আপনার মনে হবে—এমনই একজন শিক্ষকের খুব দরকার ছিল আমার। আপনার ভাবনা তখনও ফুরোয়নি পুরোপুরি। জানতে পারবেন— স্যারকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এর খানিকক্ষণ আগে দেখা যাবে খুদে খাকিদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। বিশ্বাস করুন—এই রাজনীতিটা বড়ই পরিচিত মনে হবে আপনার। হ্যাঁ, গল্পটা আপনারই। গল্পটা আমারও। গল্পটা আমাদের।
*
জাদুকর রুমাল নাড়ালে কবুতর বেরিয়ে আসে। খালি হাত খুললে আপেল দেখা যায়। আর জাদুকর যখন হাত পা গুটিয়ে ঝিম মেরে বসে থাকেন, তখনও আমরা থাকি তার জাদুর অধীন। জাদুর রেশ কাটিয়ে উঠতে সময় লাগে আমাদের। এই গল্পের লেখককে আমি জাদুকর ভাবি। একটা দৃশ্যের ভেতরে মিলনের শূন্যতা সমেত গল্পটা শেষ হলে শাহাদুজ্জামানকে আমি একজন শফিক স্যার হিশাবে আবিষ্কার করি। যিনি বলেন—সিলেবাসের মাইনর লেখকদেরকে লেখা পড়াবো না আমি। ওটা তোমরাই পড়ে নিয়ো। আমি পড়াবো মেজর লেখকদের লেখা। তিনি প্রশ্ন তুলতে জানেন।