জীবন দিয়েছি কুরবান!

আমি জন্মেছি মুসলিম বাংলার এক বনেদি পরিবারে। আদিকাল থেকেই এই পরিবার নিজ এলাকায় ধার্মিকতার জন্য প্রসিদ্ধ ও সর্বজন শ্রদ্ধেয়। এককালে বিরাট তালুকদারী ছিল। কালের আবর্তনে জাগতিক অর্জনে সংযোজন বিয়োজন হলেও সমান তালে বহাল আছে ধার্মিকতা এবং ধর্মীয় শিক্ষা। সেই সুবাদেই আমার বাবা বর্তমান পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় শিক্ষা কারিকুলাম দরসে নেজামী অর্থাৎ কওমী মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন। শিক্ষা সমাপন পরবর্তী সময়ে এই কওমী মাদ্রাসাকে আপন ঘরের মতো আবাস বানিয়েছেন।
জ্ঞাত ব্যক্তি মাত্রই জানেন যে, পৃথিবীর তৃতীয় শ্রেণীর আয়ের দেশ বাংলাদেশে কওমী মাদ্রাসা সংশ্লিষ্ট সকলকেই কি রকমের সংগ্রাম করে মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হয় পরকালীন প্রতিদানের অনন্ত আবেগ উচ্চাশায় !
শৈশবের দীর্ঘ সময় পল্লী গাঁয়েই কাটিয়েছি। কখনো কোনো ঈদের দিন বাবাকে বাড়িতে পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। বাবার হাত ধরে ঈদগাহে যাওয়া। ঈদের সকালে বাবার থেকে সালামি পাওয়া সেসব তো ছিল আমাদের জন্য কল্পনা। আমাদের দুরন্ত শৈশবে বাবার অনুপস্থিতি ছিল মর্মান্তিক। যদিও মানুষ অভ্যাসের দাস বলে আমরাও ধীরে ধীরে এই অনুপস্থিতির রুটিনে অভ্যস্ত হয়ে যাই। এই অভ্যস্ততার ফলেই হয়ত যখন স্কুল ছেড়ে, স্কুলের সহপাঠী আর খেলার সঙ্গীদের ছেড়ে এমনকি ছায়াঢাকা মায়াময় আমার প্রিয় গ্রাম ছেড়ে আচমকাই রাজধানীর এক চার দেয়ালে বন্দী হলাম তখন যদিও মানিয়ে নিতে অসহ্য ঠেকেছিল কিন্তু মানিয়ে নিয়েছিলাম। মক্তব নুরানী আর হিফজের পাঠ চুকিয়ে যখন কিতাব পড়তে এলাম তখনই গলায় বেড়ি পড়ল। কুরবানির পশু কিনতে কাকাদের সাথে আমাকে আর গ্রামের বাজারে পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল মাদ্রাসার সহপাঠীদের সঙ্গে রাজধানীর বড় বড় গরুর হাঁটে। এখানে যদিও নিজেদের গরু কেনার আনন্দ ছিল না। ছিল দেশের দূরাঞ্চল থেকে আগত গরুর বহর আর নানা কিসিমের গরুর ব্যাপারী দেখার এডভেঞ্চার। ইয়াব্বড় বড় ষাঁড় আর বিভিন্ন এলাকার বিচিত্র মানুষ দেখে দেখে সারা হাঁট মাত করি বন্ধুদের নিয়ে। তারপর ঈদের দিন! মাদ্রাসার পক্ষ থেকে জনগণের কল্যাণকামী হয়ে মানুষের ফরজে কেফায়া দায়িত্বটুকু নিজ উদ্যোগে পালন করতে ধারালো চকচকে ছুরি নিয়ে সকাল সকাল পথে নেমে যাই। সঙ্গে উস্তাদ সহপাঠী। আর জিভে লেগে থাকে ভোরে মাদ্রাসার পক্ষ থেকে সুস্বাদু সুগন্ধ মিষ্টান্নের আলতু স্বাদ। মন খারাপের সময় কই?
সেই যে শুরু। গত একযুগ ধরে এই নিয়তিই আমাদের পারিবারিক রুটিন।
আমরা আমাদের জাগতিক বৈধ আনন্দ আহ্লাদ কুরবানি করেছি দীন ইসলামের সেবায় । ইসলাম তো মানুষের এই কুরবানিই কামনা করে। নিজের স্বাদ আহ্লাদ কুরবানি করে করেই তো দীনের বৃহত্তর স্বার্থে নিজের জীবনের বৃহত্তর কুরবানি দিতে প্রস্তুত হতে হয়। কুরবানির ইতিহাস থেকে এই শিক্ষাই তো আমরা পাই।
দয়াময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা আমাদের এইটুকু, তিনি যেন আমাদের এই ক্ষুদ্র ত্যাগগুলো অনুগ্রহ করে কবুল করেন। আল্লাহুম্মা আমিন।

শেয়ার করুন

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments