
[আলোচিত মাকামাতে হারিরি গ্রন্থ]
ক্লাসিকাল আরবি সাহিত্যের মশহুর টেক্সট মাকামাতে হারিরি। তেরো শতকের ইরাকি মুসাব্বির আল-ওয়াসিতি[1] মাকামাতে হারিরি কিতাবের পঞ্চাশটি মাকামাতকে সামনে রেখে মোট নিরানব্বইটি তসবির (মিনিয়েচার) তৈরি করেন। এরমধ্যে বিশেষ আকর্ষণীয় এক তসবিরে আমাদের চোখ পড়ে সবুজ একখান দ্বীপে। রহস্য বেড়ে যায় যখন দেখা যায় যে, এই চিত্রগুলা স্পষ্টতই মিলতেছে না মাকামাতের উক্ত ৩৯তম অধ্যায়ের সাথে; অথচ এমনটা হওয়ার কথা না।
এই মাকামাতের প্রধান দুই চরিত্র : ১. আবু যায়েদ সরুজি—একজন বুদ্ধিমান ভিক্ষুক; ২. হারিস ইবনে হাম্মাম—তার বিশ্বস্ত সহচর। তারা ওমানের দিকে যাত্রা শুরু করেছিল, কিন্তু যাত্রাপথে ঝড় শুরু হওয়ায় বাধ্য হয়ে এক দ্বীপে থামতে হয় তাদের । দ্বীপে তারা বেরিয়ে পড়ে খাদ্যের সন্ধানে ।
কিন্তু কোন দ্বীপ? হারিরি এর নাম বলেন না, বর্ণনাও দেন না। জাস্ট এইটা একটা দ্বীপ, কথা এখানেই শেষ। তবে কিছুটা পড়াশোনা থাকা পাঠককে এইটা অন্য আরেক দ্বীপের কথা স্মরণ করিয়ে দিবে—যেমন আরব্য রূপকথার বই হাজার রাতের গল্প-র (ألف ليلة و ليلة) কোন দ্বীপ অথবা ইবনে তুফাইলের দার্শনিক উপন্যাস হাই ইবনে ইয়াকজান-এর দ্বীপ।
এছাড়াও, মাকামাতের ৩৯তম অধ্যায় আর ইবনে তুফাইলের দার্শনিক উপন্যাস—উভয়ের মধ্যে একটা কমন মিল পাওয়া যায়, সেটা হচ্ছে, উভয় গল্পেই একটা ‘কষ্টসাধ্য’ কিংবা ‘অবাঞ্ছিত জন্মগ্রহণ’কে চিত্রায়িত করা হইছে। হাই ইবনে ইয়াকজান একটা গোপন সম্পর্কের ফলাফল ছিল, যার জন্মই হওয়া উচিত ছিল না, ফলে তার মা তাকে জন্মের পর একটা ভাঙ্গা বাক্সে ঢুকিয়ে ভাসিয়ে দেন সমুদ্রের উত্তাল বুকে । এই গল্প সেই পরিচিত গল্পেরও সাথে মিলে যায়, যেই গল্পে একটা শিশু হয়ে পড়ে পরিত্যক্ত, কিন্তু অলৌকিকভাবে বেঁচেও যায় – মোক্ষম উদাহরণ মূসা আ.-এর কাহিনি – আকস্মিকভাবে মাকামাতের এই অধ্যায়ের দুই নায়কও মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েও অলৌকিকভাবে শেষ পর্যন্ত বেঁচে ফিরে আসে সমুদ্র থেকে।
সাহিত্যের অনেক গল্পেই এই জন্মের বিষয়টা জলপানির কন্টেক্সটে হইয়া থাকে। এইটা গুরুত্বপূর্ণ যে, হারিরি একটা জটিল জন্ম দেখাইতেছেন এবং এমন এক নবজাতকের কথা বলতেছেন, যাকে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচায়ে আনা হবে।
দুই নায়ক যখন দ্বীপ ঘুরে দেখতেছিল, তারা একটা প্রাসাদ দেখতে পায়, যার দরজাটা হইতেছে লোহার আর গেইটের বাইরে দাঁড়ানো দাসদের মুখে বিষণ্ণতার ছাপ। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা জানতে পারে যে দ্বীপের যিনি শাসক, তার স্ত্রী অনেকদিনের গর্ভবতী, এখন কঠিন প্রসব-বেদনায় ভুগতেছেন; বহু প্রতীক্ষিত সন্তানটা বোধহয় মারাই যাবে; কেউ কেউ তো এমনও বিশ্বাস করতেছিল যে, ‘সন্তানটা আসলে দুনিয়ায় আসতে চায় না’। জন্মদাত্রী মা তখন ঝুঁকিতে।
ঠিক ওই সময়, আবু যায়েদ সারুজি, বুদ্ধিমান এই মানুষ, নিজেকে প্রাসব-সহজ-করার ক্ষমতাসম্পন্ন দাবি করে ওইখানে হাজির হয়। সে একটা তাবিজ তৈরি করে সেটা মহিলার উরুর উপর ঝুলায়ে রাখতে নির্দেশ দেয়।
কিন্তু সেই তাবিজে কী লিখছিল সারুজি?
সারুজি তাবিজে একটা কবিতা লিখছিল, যেইটায় নবজাতককে সতর্কবার্তা দেওয়া হয় যে, এই পৃথিবীতে আসলে ওর কী সমস্ত দুঃখ আর কষ্ট ভোগ করা লাগতে পারে। কবিতায় সারুজি তারে শক্তকরে উপদেশ দেয়—যেইখানে আছ, ওইখানেই থাক।
কিন্তু সন্তান বেচারা এই জরুরি উপদেশ শোনে না। এখন তাকে যখন মায়ের গর্ভ থেকে বাইর হতে নিষেধ করা হইতেছে, তখন সে জন্ম নিতে আরো তাড়াহুড়া শুরু করে দেয়। এবং আমরা যদি তাবিজে লেখা আবু যায়েদের কবিতার টেক্সটকে ধরি, সেখানে দেখতে পাই যে সারুজি জানাইতেছে—বাচ্চাটা এমনই একখান জগতে আসতে যাইতেছে, যা তাকে গ্রহণ করতেই প্রস্তুত না, যেখানে সে উপযুক্ত জায়গাও নিজের জন্য খুঁইজা পাবে না।
অন্য কথায়, সে একজন অবাঞ্ছিত সন্তান, যেমন অবাঞ্চিত ছিল হাই ইবনে ইয়াকজান, এবং এক অর্থে শিশু মূসাও। কাহিনির এই পর্যায়ে মানব-অস্তিত্ব আর বিশ্বজগতের মধ্যে একটা সংঘাত ও উত্তেজনা বিদ্যমান দেখা যায়, যা থেকে বিশৃঙ্খলা আর অস্থিরতা সৃষ্টি ছাড়া আর কিছুই হওয়ার সুযোগ থাকে না। এইটা একটা গভীর নিরাশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি; বুঝাইতেছে যে, এই দুনিয়ার আসলে মানুষের কোন প্রয়োজন নাই, এবং যেই দুনিয়া মানুশকে স্বাগতই জানাইতেছে না, ওই দুনিয়ায় মানুশ কেবল দুঃখ ছাড়া আর কীই-বা লাভ করতে পারে?
সুখ জিনিশটা তো মায়ের গর্ভে;
জন্ম – সে এক মর্মান্তিক পতনের নাম।
বলাই বাহুল্য, নবজাতকের পিতা প্রচণ্ড আনন্দিত হন এবং আবু যায়েদকে হাতভরে পুরস্কৃত করেন, তাকে নিজের সান্নিধ্যে রাখেন। কিন্তু হারিস ইবনে হাম্মাম সিদ্ধান্ত নেয় ওমানের দিকে সে যাত্রা অব্যাহত রাখবে। ফলে এরপর উভয় সঙ্গীর মাঝে ঘটতে হয় বিচ্ছেদ, যা কিনা মায়ের সঙ্গে সন্তানের বিচ্ছেদের মতোই কষ্টকর।
হারিস, একা হয়ে পড়ার হতাশা বুকে নিয়ে, আবু যায়েদকে বিদায় জানায়; কিন্তু তার মনের ভেতর এক ভয়ানক চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে : ‘নবজাতক আর মা বোধহয় মরে গেলেই ভালো হত।’
এখন এই গল্পই যদি চিত্রশিল্পী ওয়াসিতির হাতে পড়ে, তাহলে কী রূপ নিবে? ওয়াসিতি এই গল্পকে চারটা চিত্রে (মিনিয়েচার) অলঙ্কৃত করছেন, যা কিনা এই গল্পের জন্য একটা বিশেষ ও বাড়তি সম্মান বলা চলে। (কারণ হারিরি লিখছিলেন মোট পঞ্চাশটা মাকামাত, তাই গড়পড়তায় প্রতি মাকামার জন্য দুইটা করে চিত্র পড়ার কথা; কিন্তু এই গল্পের ভাগে পড়তেছে চারটা, অতএব এইটা বিশেষ কিছুই বটে।)

[প্রথম চিত্র; দ্বীপ অধ্যায়ের জন্য ওয়াসিতির আঁকা চারটা চিত্রের প্রথম চিত্র, যেখানো জাহাজ নিয়ে নাবিককে যাত্রা শুরু অবস্থায় দেখা যায়।]

[দ্বিতীয় চিত্র; যেখানে কাহিনির মূল প্লট দ্বীপকে চিত্রায়িত করা হইছে।]

[তৃতীয় চিত্র; প্রাসাদের সামনে : হারিরি, হারিস, ফলের ঝুড়ি ও দাসেরা।]
প্রথম চিত্রে জাহাজটাকে তার যাত্রা শুরুর মুহূর্তে দেখা যায়। দ্বিতীয়টায় চিত্রিত দেখি স্বয়ং দ্বীপকে (দ্বীপের বিস্তারিত আলোচনা পরে করা হবে)। তৃতীয় চিত্রে আবু যায়েদ ও হারিসকে শাসকের প্রাসাদের সামনে দেখা যায়; বামদিকে তিনজন বিষণ্ণ ক্রীতদাস, আর ডানদিকে আবু যায়েদ ও হারিস। আবু যায়েদের হাতে আছে একটা ঝুড়ি, যেটা তাদের খাবারের সন্ধানে বের হওয়ার কথা স্মরণ করায়ে দেয়।
এই চিত্রে সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ে যা তা হচ্ছে—প্রাসাদের শক্তকরে লাগানো বন্ধ দরজা আর জানালাগুলা। হারিরির লেখায় কেবলমাত্র একটা লোহার দরজার কথাই উল্লেখ মিলে, অথচ ওয়াসিতি এখানে তিনটা বন্ধ জানালা চিত্রিত করছেন, যেগুলার কোন উল্লেখই মাকামাতে করা হয় নাই।
এই অতিরিক্ততার কারণ কী?
এই অতিরিক্ততা তৈরি করে ওয়াসতি আসলে যা করছেন তা হল – এই যে সন্তান-জন্মকালীন বন্ধত্বের একটা অবস্থা (যেটাকে হারিরি লোহার বন্ধ দরজা লিখে বুঝাইছেন), ওয়াসিতি সেই অবস্থার উপর আরো জোর দিতে যেয়ে, পরিস্থিতির মাত্রাকে আরো বাড়ায়ে তুলতে যেয়ে তিনি বাড়তি করে জানালা আঁকছেন, এমনকি তিনটা জানালা আঁকছেন—ফলে চিত্রটা পুরোপুরি একটা সঙ্কটাপন্ন জন্মগ্রহণের পরিস্থিতিকে ফুটায়ে তুলছে; যেন-বা শিশুটা গর্ভ থেকে বাইরে চলে আসার কোন ফাঁকফোকরও খুঁজে না পায় ।

[চতুর্থ চিত্র : যেখানে নিচে শাসক-পত্নী গর্ভাবস্থায় বসে আছে দাসীদের নিয়ে, উপরে শাসক, বামে তাবিজ-হাতে সারুজি, ডানে অ্যাস্ট্রোল্যাব-হাতে হারিস।]
চতুর্থ চিত্র হয়তো সবচেয়ে জটিল। উপরের অংশ থেকে মাঝামাঝিতে শাসক বসা, বামদিকে আবু যায়েদ তাবিজ লিখতেছে এবং ডানদিকে হারিস একটা অ্যাস্ট্রোল্যাব-হাতে। নিচের অংশ থেকে মাঝামাঝিতে, প্রসব যন্ত্রণায় থাকা শাসক-পত্নীর বিশালাকৃতির ছবি; অন্যান্য চরিত্রগুলোর তুলনায় তার আকার এরকম বড় যে, কেউ কেউ এইটাকে প্রজনন-ক্ষমতা বুঝানোর উদ্দেশ্যে মেটাফোর বইলাও মনে করছেন।
এখন আমরা সেই চিত্রের দিকে মনোযোগ দিব যা আমাদের আলোচনার মূল থিম। দ্বিতীয় চিত্র উপস্থাপন করতেছে দ্বীপকে—মানে দ্বীপ-বাগানকে।
ওয়াসিতি এখানে কিছু এমন এমন জিনিশ আঁকছেন যা আদতে হারিরির বর্ণনাতেই নাই। ওয়াসিতি প্রকৃতিক দৃশ্যকে যেভাবে চিত্রায়িত করছেন এবং বাগান-চিত্রায়ণে যেই সৃষ্টিশীলতা দেখাইছেন, তার ফলে এই মাকামাত ব্যাপক সমৃদ্ধ যেমন হইছে, তেমনই এর অর্থে যোগ হইছে এক নতুন মাত্রা।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তিনি কেন এমনটা করছেন? কেন এমন কিছু আঁকছেন যা আদতে টেক্সটের ভেতর নাই-ই?
আলবৎ তার কল্পনাজগৎ, যেমনটা অনেকেই বলছেন, আলিফ-লায়লার নাবিকদের কেচ্চাকাহিনি দ্বারা প্রভাবিত ছিল। কিন্তু যদি আমরা চিত্রের গভীরে দৃষ্টি দেওয়ার চেষ্টা করি তাহলে হারিরির মাকামাতের সঙ্গে এই আর্ট-সৃষ্টিশীলতার একটা গভীর সংযোগ খুঁজে পাই।
আগে দেখা যাক দর্শকের সামনে এই চিত্র মূলত কী উপস্থাপন করে—চিত্রের সামনের অংশে একটা জলাশয়, যাতে চারটা মাছ; এর পিছনে তিনটা গাছ, চারটা বানর আর চারটা পাখি, যার মধ্যে একটা টিয়া; দুইটা গাছ ফলের ভারে নুয়ে পড়ছে, যা প্রাচুর্য আর পূর্ণতার প্রতীকী, একইসাথে প্রসব-যন্ত্রণায় থাকা পত্নীর প্রজনন-ক্ষমতার প্রতি ইঙ্গিতবাহী একটা ম্যাটাফরও।
কিন্তু প্রাকৃতিক এই দৃশ্যের মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়কর এলিমেন্ট যা তা হচ্ছে—দুইটা হাইব্রিড প্রাণী : মাটিতে চলতেছে সেগুলা; তারা একে অপরের দিকে পিঠ ফিরায়ে দুই বিপরীত দিকে তাকায়ে আছে।
প্রথম প্রাণীটার মাথা একজন নারীর এবং দেহ হচ্ছে পাখির—এটা হারপিয়া : গ্রিক মিথোডলজির ‘নারী-পাখি’। দ্বিতীয়টা একজন পুরুষের (মুকুটধারী), যার দেহ হচ্ছে সিংহের—এটা খিমাইরা : একে গ্রিক মিথোলজির স্ফিংস বলা হয়।
আরব সংস্কৃতিতে হারপিয়া ও খিমাইরা খুব পরিচিত না যদিও, কিন্তু এই হাইব্রিড প্রাণীগুলা আলিফ লায়লা বা আরব্য রজনী-তে অবশ্যই আছে। আলিফ-লায়লার এক গল্পে হাসিব করিমুদ্দিন, একটা চরিত্র, ‘বালুকিয়া’ নামে এক দ্বীপে পৌঁছায়। সেখানে বহু গাছপালা, গাছপালার ফল হচ্ছে মানুষের মাথার মতো এবং ডালেপালে সেই মাথার মতো ফলমূল ঝুলে আছে চুলের সাহায্যে। আবার কিছু গাছে ফলমূল হিশাবে দেখা যায় সবুজ পাখিদের, গাছে যারা ঝুলে আছে পায়ের সাহায্যে।
তো সবদিকে খেয়াল রেখে, এই চিত্রে আমরা দৃষ্টি দিলে দেখতে পাই যে—প্রাণী আর উদ্ভিদ, মানুষ আর অ-মানুষের মধ্যে প্রচলিত বিভাজন লঙ্ঘিত হইছে এই গল্পের বর্ণনায়। একই গল্পে, এবং একইভাবে আরব্য রজনীর আরেক চরিত্র স্বর্ণকার হাসান বসরির গল্পেও, দেখা যায় এইরকমই আজুগুবি দৃশ্য : কিছু পাখি তাদের পালকের পোশাক ছেড়ে দিয়ে ধারণ করছে চাঁদের মতো সুন্দরী মেয়েদের রূপ; অর্থাৎ এখানে মানুষ আর পাখির মধ্যকার পার্থক্যও মানা হয় নাই। কিন্তু কথা হচ্ছে হারিরির লেখা মাকামাতে তো এমন বিস্ময়কর প্রাণীর কোনো কথাই নাই। তাহলে ওয়াসিতি আসলে কী চিত্রিত করতে চাইছিলেন?
যাইহোক, ওয়াসিতি তার মিনিয়েচারে দর্শকের সামনে দুইটা অত্যন্ত অদ্ভুত প্রাণীকে উপস্থাপন করছেন। এবং তা ‘অদ্ভুত’—যাকে লাকাঁ[2] বলছেন—‘এট্রাঞ্জ’, অর্থাৎ, এক ধরনের ‘ফেরেশতা’।
একটা বিষয় তো নিশ্চিত, যে, ফেরেশতারা কখনো মানুষের আগমনকে সাদরে গ্রহণ করে নাই। খেয়াল করি তারা আল্লাহ তাআলাকে কী বলছিলেন আদমকে সৃষ্টি করার সময় : ‘আপনি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন যারা সেখানে অশান্তি সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে, অথচ আপনার প্রশংসা আর পবিত্রতা তো আমরা ঘোষণা করছিই?’; আমরা আল্লাহর উত্তরও স্মরণ করি : ‘আমি তা জানি, তোমরা যা জানো না।’
তবে আবারও বলতে হয়, এসবের কিছুই হারিরির টেক্সটে আসলে উপস্থিত নাই। অনস্বীকার্য যে, এই ছবিতে চিত্রায়িত দ্বীপ নিঃসন্দেহে একটা মৌলিক সৃষ্টির উদাহরণ, যা ওয়াসিতির নিজস্ব শিল্প-জগতের কল্পনারই সংযোজন। কিন্তু আমরা কি খেয়াল করলে, এই বাগানে আদমের জান্নাত (গার্ডেন অব ইডেন)-এর অনুরূপ সাদৃশ্যও দেখতে পাই না?
এইটা এমন এক গার্ডেন অব ইডেন, যেখানে কোন সাপ নাই—অন্তত প্রথম নজরে সাপ নজরে পড়ে না। তবে মাঝখানের দিকে খেয়াল দিলে সেখানে দণ্ডায়মান একটা গাছ দেখতে মিলে, যা অন্য গাছদের মতো ফল বইতেছে না; সেটা দেখতে লাগে একটা সাপের আকৃতির মতো গাছ।
তবে এই গার্ডেন অব ইডেন বা আদম-জান্নাতের সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছে, এখানে কোন মানুষের উপস্থিতি নাই। ফলে এইটা পাপ-পূর্ব গার্ডেন অব ইডেন, মানুষের সৃষ্টিরও আগের। মানে এইটা স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং মানুষের কোনো প্রয়োজন নাই এইখানে এখনও।
কিন্তু তারপরও, মানুশ একেবারে এখানে অনুপস্থিতও না। মানুশকে দেখা যাইতেছে ওইযে দ্বীপের প্রান্তে, পেছনের দিকে। ছবির বাম পাশে একটা জাহাজের সম্মুখভাগ ও একজন নাবিককেও দেখা যাইতেছে। নোঙরটিও দৃশ্যমান, যা এখনও ফেলা হয় নাই। নাবিক, যার দৃষ্টি দ্বীপ থেকে সরে আছে, যে এখনও দ্বীপের মাটিতে পা ফেলে নাই, সে নামার জন্য এবং এইখানে বসতি গাড়ার জন্য প্রস্তুতি নিতেছে; ঠিক যেন-বা হারিরির মাকামাতে বর্ণিত ভূমিষ্ট হইতে চাওয়া শিশু—যে পৃথিবীতে প্রবেশের জন্য প্রস্তু হইতেছে।
[1] ইয়াহয়া বিন মুহাম্মাদ আল-ওয়াসিতি। আব্বাসি আমলের একজন আরব মুসলিম চারুশিল্পী ও লিপিকার। তিনি ইসলামিক মিনিয়েচারে তার শিল্পদক্ষতার জন্য পরিচিত। এমনকি তাকে বাগদাদের স্কুল অফ পেইন্টিংয়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিশেবে গণ্য করা হয়। মাকামাতে হারিরির উপর মিনিয়েচারই তার প্রথম কাজ এবং এই কর্মের মাধ্যমেই তিনি ইসলামি মিনিয়েচারের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছেন।
[2] জ্যাক লাঁক, ফরাসি মনোসমীক্ষক ও মনোরোগ চিকিৎসক। উত্তর-কাঠামোবাদ, সমালোচনাতত্ত্ব, ভাষাবিজ্ঞান, বিংশ শতাব্দীর ফরাসি দর্শন, চলচ্চিত্রতত্ত্ব এবং ক্লিনিকাল মনোসমীক্ষণে তার চিন্তার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে।