চিরায়ত

যাইতুন

তাকে ভুলে যেতে পারতাম। কৈশোর পেরোনো তারুণ্য আমাকে এতদূর নিয়ে এসেছে যে, শৈশবের কোন স্মৃতিই মনে রাখবার কোন কার্যকারিতা আর বাকি নেই। শুধু পরিণত স্বপ্নের সামনে বসে থাকা অথবা ঝরা পাতার হাহাকার নিয়ে ছুটতে থাকা প্রহেলিকার পেছনে। তবু মনের কোথাও যেনো তাকে নিয়ে স্মৃতি জমত। কোথাও উঠোনে বৃষ্টি পড়ত অনিশেষ দীর্ঘশ্বাসের মতো। অথবা কখনো অবিরল কান্নায় কাঁপুনি উঠতো সর্বদেহে।

আমরা তখন ছোট, শিশিরের ফোঁটার মতো কোমল আর সাবলীল। কথায় সড়গড়, চলনে চঞ্চল। কায়দা বা আমপারা হাতে খুব ভোরে আমরা বের হই। ঘাসে ঢাকা সবুজ পথ, শিশিরের অপূর্ব সৌন্দর্য । সকালটা আমরা কাটাই আহলাদে, শাসনহীন এক আরামদায়ক মকতবে। উস্তাদ ছিলেন দাদার বয়েসী এক মুরব্বি। দাড়িশোভিত আলোকময় চেহারা। ঠোঁটের ফাঁকে এক টুকরো প্রশ্রয় এবং পরিশ্রমের হাসি আমাদের সবসময় নির্ভয়ে রাখতো। একটা বেত ছিলো বটে, কিন্তু ওটার চেহারা ছিলো নিদারুণ নীরিহ এবং নির্মোহ। হুজুর যদি কখনোবা শাসনের এরাদায় বেত হাতে নিতেন, মনে হতো আমাদর মতো বেতটাও হা হা করে হেসে দিচ্ছে।

বাল্য বয়সে হুজুরের সেসব ছায়াশীতল দরস থেকেই তার সাথে আমার প্রেম শুরু। যখন মধুর কোন স্বর ‍ও উচ্চারণে তার নাম ও পটভূমি কানে পশে,আমার মনে হয়, কোথাও যেনো কেউ আমাকে ডাকছে। অবিরত, এবং থেমে থেমে । ক্লান্ত কণ্ঠে অশ্রুর আভাস, এতে উচ্চারণটা পুরোপুরি হচ্ছে না। ভাঙা ভাঙা, যেন সমুদ্রের চঞ্চল ঢেউ চলন্ত কোন কিছুর ঘর্ষণে কাঁচের মতো ভাঙছে।

হুজুরের কণ্ঠ যে খুব সুললিত ছিলো অথবা কণ্ঠে আরোপিত কোন সুর ছিলো,ব্যাপারটা এরকম না। কিন্তু মনে হত,যখন তিলাওয়াত করতেন,আবেগে উদ্বেলে এবং অপরিসীম দরদে হুজুরের সর্বাঙ্গ কাঁপতে থাকতো। আমি বুঝতাম,এ দরদ শুধুমাত্র ‍তিলাওয়াতের ছিলো না। ছিলো অন্য কিছুর,দূরপনেয় অথবা দূরদেশের কোন নিরাভরণ এবং উদ্বাস্তু পরিবারের।

বিশেষত হুজুর সুরা তীন খুব সুন্দর এবং অতুলনীয়ভাবে পড়তেন। মশক করানোর সময় হুজুরের এ আবেগ টের পেতাম আমরা । বলতে দ্বিধা নেই, যাইতুনের সাথে আমার প্রথম পরিচয় এবং প্রেম হুজুরের মশকের মজলিস থেকেই হয়। সুরা তীন পড়বার সময় হুজুর যাইতুন শব্দটা খুব মোলায়েমভাবে উচ্চারণ করতেন। মনে হতো, হুজুর এই সুর ও উচ্চারণের ভেতর দিয়ে কোথাও যেনো হারিয়ে যাচ্ছেন। যেনবা গহীন বনে দিকহারা ছোট বোনকে ‘যাইতুন যাইতুন’ বলে ডাকছেন। অথবা গ্রামের ব্যাকুল গৃহিণীর মতো সন্ধ্যাবেলায় হারানো হাঁসছানাকে খোঁজছেন পুকুরপাড়ে ।

আমরা বুঝতাম না, কিন্তু বোঝার আকুলতা ছিলো। আবেগ টের পেতাম, কিন্তু আবেগের সূত্র খোঁজে পেতাম না। এভাবে যাইতুনের সাথে আমরা বেড়ে উঠছিলাম। হুজুরের মতো আমরাও খোঁজতাম যাইতুনকে। মাঝে মাঝে কলরোল করে সুরা তীন পড়বার সময় বেশ সুন্দর পরিবেশ তৈরি হতো মকতবে। আমাদের এরকম দলবদ্ধ পড়া দেখে হুজুর মুচকি হাসতেন।

দুই.
ইতিমধ্যে যাইতুন কে ঘিরে আমাদের মাঝে বেশ ভালোরকম প্রশ্ন তৈরি হয়। এগুলো নিয়ে আমরা সর্বক্ষণ নাড়াচাডা করি। পরিপার্শ্বিক এবং সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে যাইতুনকে নিরীক্ষা করার চেষ্টা চলে নিয়মিত। প্রশ্নগুলো খুব মৌলিক । যেমন ধরা যাক,যাইতুন কে আসলে? ছেলে না মেয়ে? দেখতে সুন্দর না অসুন্দর? বাড়ি কোথায় তার? কেমন তার জীবন ও যাপন? সে কি দু:খ পেলে কাঁদে? নাকি তার জীবন স্বাভাবিক ও স্রোতেলা? একটা বুলবুলি বা পুকুরের নীল মাছের মতো বাঁধাহীন!

আজ এতদিন পর স্মৃতি খোঁড়ে বেদনার এ গল্প লিখতে বসে একটা কথা খুব মনে পড়ছে। যাইতুনকে নিয়ে ওসব আলোচনা শৈশবে আমাদের জীবনযাপনে কিছুটা হলেও গতি এনে দিয়েছিলো। শোনতে হাস্যকর এবং অবিশ্বাস্য লাগছে। আমার নিজের কাছেও। ওই রকম একটি পিচ্ছিল বিষয় নিয়ে সেই দুধশৈশবে ভাববার মতো কি বুদ্ধি হয়েছিলো! বাস্তব বললে, না। আমরা মূলত নামের প্রেমে পড়েছি,এর পেছনে কে ছিলো,এটা নিয়ে ভাবনাই ছিলেো না। তাছাড়া আমপারা পড়বার সময় সুরা তীনকে আমরা ভালোবেসে ফেলেছিলাম। সুরা তীনে যাইতুন শব্দটা আমাদের স্পর্শ করত বৃষ্টির মোলায়েম ফোঁটার মতো। কিন্তু এর পেছনের গল্প আমাদের কারুরই জানা ছিলো না । তবে জানার আগ্রহ আমরা এক ‍চিরকেলে আবেগের মতো হৃদয়ে পুষতাম। বৃহস্পতিবার এলেই হুজুরকে আবদারে আবদারে বিরক্ত করে ফেলতাম। হুজুর প্রশ্রয় দিতেন আবার খুব শিশুতোষভাবে প্রত্যাখ্যানও করতেন। গল্পটা বলার একটা ইচ্ছেও মনে হতো হুজুরের মনে উদিত হয়েই আবার মিশে যেতো হাওয়াই মিঠার মতো। এভাবেই চলতো নিত্য। আমরাও হাঁফ ছেড়ে দিতাম না।

শিশুতোষ আবেগে আমরা পাখির বাসার খোঁজার মতো সারাদিন এই যাইতুনের পেছনে পড়ে থাকতাম। ‍আলোচনার ছিলো না তেমন কিছুই,নামটা ছাড়া তো আর তেমন কিছু জানতাম না আমরা। তবুও অস্পৃশ্য ভালোবসার মতো করে আমরা যাইতুনকে অনুভবে জীবিত রাখতাম। আর আমাদের ছিলো ছুটবার সময়। শৈশবের সবচে তাজা ও টাটকা সময়ে আমরা এভাবে কুয়াশা ফুল পাখি অথবা এরকম অস্তিত্বহীন যাইতুনের পেছনে খরচ ফেলতাম দুপুরগুলো।

তিন.
‘যাইতুনের গল্প শুনতে চাও ?
একদিন ক্লাসে এসে হুজুর আমাদের এ প্রশ্নটা করলেন। হুজুরের সেই চিরাচরিত হাসি আর আহলাদ মাখা চেহারায় কিসের কালোছায়া যেনো। স্বাভাবিকভাবে এরকম প্রশ্ন হুজুর হেসেই করেন। আজ কী হলো তাহলে ?
আমাদের চিন্তা ও মনস্তত্ব এইটুকু ভেবেই চোখা হয়ে উঠলো। ভেতরে ভেতরে খুশিতে ডগমগিয়ে উঠলেও অন্যদিনের মতো আমরা চিৎকার করে জীীীীী বলে উঠলাম না। শান্ত এবং গম্ভীরভাবে বললাম জি হুজুর, শুনতে চাই।

মুচকি হাসলেন হুজুর। তবে হাসিটা স্বতস্ফূর্ত না,চাপা কিম্বা অনভ্যস্ত।

এরপর হুজুর আমাদেরকে হাত ধরে নিয়ে গেলেন অনেক দূর। যেখানে আছে ভালোবাসা,আছে হাহাকার,আছে বিস্ময় আর আছে তীব্র অবিচলতা। গল্প বলায় হুজুর পারদর্শীতা ছিলো প্রবাদপ্রতীম। শিশুতোষ ভাষা ও ভঙ্গি ছিলো নখদর্পণে । আমরা দুষ্টের দল হুজুরের যে কোন গল্প কিম্বা নসিহত খুব নিমগ্ন হয়ে শুনতাম। শুধুমাত্র হুজুরের বলার দক্ষতার কারণে। আমাদের কিছু বলার সময় হুজুর পুরোদস্তুর শিশু হয়ে যেতেন। সে এক মজার দৃশ্য।

যাইতুন কোথায় থাকে বলো তো ?
হুজুরের অদ্ভুত প্রশ্ন।
আমরা সমস্বরে বললাম, জানি না হুজুর।
চলো তাহলে,জেনে আসি।

ভূমধ্যসাগরের পাড়ে ফিলিস্তিন নামে এক টুকরো দেশ আছে। জান্নাতের মতো সুন্দর সৌম্য শ্যামল এক দেশ। তোমরা নাম শোনে থাকবে নিশ্চয়। আমাদের যাইতুন থাকে সেই দূরদেশে। ফিলিস্তিনে। সে তার ডালের ছায়ায় মানুষদের বসতে দেয়। তাদের আরাম দেয়। উপকারী ফল দেয়। যাইতুন একটি ফলের নাম। গাছের নাম। বরকতময় গাছ।

আমরা মনে মনে বেশ বিস্মিত হলাম। যাইতুন তাহলে গাছের নাম। এইটুকু শোনেই আমাদের কৌতূহলও বাড়তে থাকে। হুজুরকে প্রশ্ন করি।

এরপর হুজুর অশ্রুসজল ভাষায় আমাদের ফিলিস্তিনের কথা শোনান। শোনান বাইতুল মাকদিস আর কুব্বাতুস সাখরার কথা। তীন-যাইতুনের কথা। আমরা শোনি । কেঁদে ফেলে আমাদের শিশু হৃদয়। ফিলিস্তিনের জন্য মনে জমে উঠে গভীর ভালাবাসা। তীব্র এক চিরকেলে প্রেম।

এভাবে আমরা ফিলিস্তিনকে ভালোবেসে যাই। ভালোবসি যাইতুনকে। তীনকে। বাইতুল মাকদিসকে। কুব্বাতুস সাখরা কে।

চার.
হুজুর ফিলিস্তিনের যে প্রেম আমাদের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন,এটা আামাদের আজ এতদূর নিয়ে এসেছে। আমি আর নিবরাস — হুজুরের সবচে প্রিয় ছাত্র সেই ভালোবাসা সূত্র আজ ফিলিস্তিনে। একটি যাইতুন বৃক্ষ আমাদের ছায়া হয়ে আছে। একটি পাথরখন্ডে মাথা রেখে আহত গুলিবিদ্ধ নিবরাস কে আমি শুইয়ে রেখেছি।গুলিটা ওর বুক বরাবর লেগেছে। এরমধ্যে রক্ত ঝরে গেছে প্রচুর। গুলিটা বের করার চেষ্টা করছি আমি। হঠাৎ ফায়ারের শব্দ হলো। নিবরাস অভ্যাসমতো শব্দ শোনেই রাইফেলটা হাতে নেয়ার চেষ্টা করল। আমি শুইয়ে দিলাম আবার।

একটি ইজরায়েলি সৈন্য আমাদের টার্গেট করেই ফায়ার করেছে। কিন্তু যাইতুনের আড়ালে থাকায় গুলিটা লাগে নাই। এবার আমি সতর্ক হয়ে রাইফেলটা বাগিয়ে স্নাইপারের মতো উপুড় হয়ে শোয়ে গেলাম। বজ্জাত সৈন্যটা আমাদের আবার টার্গেট করার চেষ্ট করছে। একটু দাঁড়ানো মাত্রই আমি টার্গেট করলাম। পড়ে গেলো কাটা কলা গাছের মতো।

এরমধ্যে নিবরাস জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। অনেক কসরত করে বুলেটটা বের করে রক্ত বন্ধ করলাম। এরপর আর কিছু করার ছিলো না। আশপাশের কোন হাসপাতালেই যাওয়া যাবে না। বর্বররা হাসপাতালগুলোকে ক্যাম্প বানিয়ে ফেলছে। তাহলে উপায়!

ভাবতেই ভাবতেই দেখলাম নিবরাস আস্তে করে চোখ খুলল। হাসল একটু, তৃপ্তির হাসি।
‘নাবিল ভাই,আমি মনে হয় আর বেশি সময় বাঁচবো না। আল্লাহ আমার আশাকে পূরণ করেছেন। আমি শহিদ হয়ে যাবো। দেশে ফিরে আম্মুকে আমার সালাম দেবেন। নুযহা আর যাহরা— আমার দু বোনকে আমার আদর দেবেন। আব্বুকে বলবেন, আমি তার ওয়াদা রক্ষা করেছি।

আমি কেঁদে ফেললাম। জলোচ্ছ্বাসের মতো আমার কান্না আসতে লাগলো। কিন্তু,আামার তো কাঁদলে চলবে না। শক্ত হতে হবে। সবর করতে হবে।
আবাল্য যাইতুনকে ভালোবেসে আসা নিবরাস কে আমি যাইতুনের শীতল পবিত্র শান্ত ছায়ায় শুইয়ে দিলাম। কবরের সামনে একটা পাথরের অ্যাপিটাফ লাগিয়ে দিলাম। এতে হাতে লাগা নিবরাস ের রক্ত দিয়ে খোদাই করে আরবিতে লিখলাম : ‘আশ-শাহিদুল বাতাল নিবরাস ুর রহমান মিন বাংলাদেশ।’ বাংলায় বললে : সাহসী শহিদ নিবরাস ুর রহমান, বাংলাদেশ থেকে।

অশ্রুর সর্বশেষ ফোঁটাটুকু ওর কবরের শীতল মাটিতে ফেলে আমি সিগন্যাল অনুযায়ী তেরোতম সুরঙ্গে প্রবেশ করলাম । আগামীকাল খান ইউনিসে আরেক দফা অপারেশান করতে হবে। শরীর ক্লান্ত। হৃদয় বিমর্ষ।

পাঁচ.
নিবরাস শহিদ হওয়ার তিনদিন পর আজ রাতে জাবালিয়ার ৩১৩ নম্বর সুরঙ্গের একটি সংকীর্ণ কামরায় বসে এ স্মৃতিগল্পটি লিখলাম। নিবরাস ের সালাম বা অন্তত তার শাহাদাতের খবর তার আম্মুকে পৌঁছাতে পারব কিনা,এ চিন্তা করতে করতে বিছানায় যাচ্ছি। যুদ্ধ তীব্র ও দীর্ঘ হচ্ছে। আর বিজয় হচ্ছে নিকটবর্তী । বিজয় আসবে বিজয়। ফিলিস্তিন স্বাধীন হবে। নিবরাস ের মতো শহিদদের রক্ত বৃথা যাবে না।

জিমেইল : khubaibmahmud063@gmail.com

শেয়ার করুন