দে দৌড়

রাজলক্ষ্মী ওভার ব্রীজের নিচে গিয়ে হাসিফকে কল দিলাম। কী রে হাসিফ তুই কই?

‘অফিসে।’

‘অফিস কয় তলায়?’

‘সাত তলায়। তুই সাত তলায় আয়।’

লিফট থাকতেও আমি সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠলাম আর মনে মনে বললাম, যাক, মারাত্মক একটা ব্যায়াম হয়ে গেল শরীরে। উঠতে উঠতে পৌঁছে গেলাম সাত তলায়।

অফিসের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে লম্বা লম্বা শ্বাস নিলাম। এমন সময় হাসিফ ফোনে কার সাথে যেন কথা বলতে বলতে বের হল। আমি ‘হাসিফ’ ডাকতেই সে পেছনে ফিরল। 

‘ও তুই এসেছিস। আচ্ছা, নীচ তলায় আয়।’

‘মাত্রই না নীচ তলা থেকে উঠলাম?’

‘উঠছোস ভালো হইছে, এখন আবার নাম।’

‘তুই আগে বললেই পারতি আমি নীচ তলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোর জন্য উপেক্ষা করতাম।’

‘অপেক্ষা করার দরকার নাই। তুই আয়।’

‘না রে দোস্ত, এখন সিঁড়ি বেয়ে নীচে যেতে পারব না। পা ব্যথা হয়ে গেছে। তুই লিফটে চল।’

সে বলল, না না না, এ হয় না। সকালে লিফটে  ওপরে এসেছি। নামার সময়ও যদি লিফট ব্যবহার করি তাহলে আমার ব্যায়াম হবে না। সারাদিনে একবার ব্যায়াম করার জন্য সিঁড়ি বেয়ে আমার নামতেই হয়। তা না হলে গর্ভবতী মহিলার মতো আমার পেট বেড়ে যায়। তোর ভাবী রাগ করে।

‘একদিন অবাধ্য হলে কিছু হবে না।’

‘এই একদিন একদিন করেও ত আমরা সারাজীবনে অপরাধের সংখ্যা বাড়াই।’ 

‘হয়েছে হয়েছে, জ্ঞান দিস না, চুপ থাক।’

কী আর করব! বাধ্য হয়ে বললাম, যা তোর পেটের ওপর দয়া করলাম। 

সিঁড়ি বেয়ে নীচ তলায় এসে দু’জন দুইটা পাকা আমের জুস গলায় ঢাললাম। বললাম, চল, উত্তরা চার নম্বর পার্কের এক নম্বর রোডে যাই? তোর সাথে নিরিবিলি কিছু কথা আছে। 

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আমরা দু’জন হাঁটছি রাস্তার এক পাশ দিয়ে। রাস্তায় কোনো লোকজন নেই। হঠাৎ হঠাৎ পেছন থেকে রিকশার টুংটাং বেলের শব্দ ছুটে আসছে। রাস্তার পাশের নিয়নবাতিগুলোও নষ্ট। সন্ধ্যা না হতেই চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই হয় এদিকটাই। হাসিফের ভয় ভয় লাগছে। আমাকে বলল, কী রে শাকের, তুই এত এত জায়গা থাকতে আমাকে এই জায়গায় নিয়ে এলি ক্যান?

আমি সাদাসিধা জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত। যেখানে সেখানে রাত-বিরেতে চলা ফেরা করি। আমার কোনো ভয় লাগে না।  আমি ভয়ও পাই না। 

বললাম, এমনই। এদিকটা কী সুন্দর দেখিস না? কোনো হৈচৈ নেই, হকারদের আনাগোনা নেই, খুব বেশি একটা লোকজনও নেই। কেমন যেন শ্মশানপুর মনে হয়। আমরা হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। পেছন থেকে আওয়াজ এলো ধর ধর ধর। হাসিফ তো ভয়ে কুঁকড়ে রাস্তার পাশের দেয়ালের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। মাথা কালো কাপড়ে ঢাকা। তিনজন যুবক আমাদের দিকেই আসছে। আমিও একটু ভয় পাচ্ছিলাম। কিন্তু সেটা হাসিফকে বুঝতে দিলাম না। তাকে বললাম, হাসিফ, তুই তোর সমস্ত সাহস আমার কাছে ট্রান্সফার কর। সে কেঁদে উঠে বলল, ওদের হাতে ছোরা দেখা যাচ্ছে আর তুই এমন পরিস্থিতিতে আমার সাথে মজা করছিস? 

আমি আমার সবটুকু সাহস এক করে ধর ধর করে এগিয়ে গেলাম। ছিনতাইকারী তিনজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল হাসিফের সামনে। হাসিফ অতিরিক্ত বিনয় দেখিয়ে ওদেরকে বলল, ভাইজানরা কি ব্যথা পাইছেন? 

একজন কুঁকিয়ে উঠে বলল, শা লা আমগো লগে বিটলামি করোস? ঘ্যাচাং কইরা গলায় বসায়া দিমু, বুঝবি ঠ্যালা!

তারা তিনজন উঠতে উঠতে লোকজন এসে পড়ল। তারা ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। দুজন কোনো মতো জানে বেঁচে গেল। একজন নীচে পড়ে রইল। সে উঠতে পারছে না। লোকজন তাকে বেদমপ্রহার করতে লাগল। আমি সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ভাই সকল অফ যান। ছোট্ট একটা পরামর্শ দিতে আসছি। শুনেন তারপর তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ুন। কেউ আমার কথা শুনছে না দেখে ছিনতাইকারী নীচ থেকে চেঁচিয়ে উঠল, আফনারা ত আমারে মাইরেই ফেলবেন। ভাইয়ের ছোট্ট একটা পরামর্শ নেন, তারপর না হয় আবারও মারধর স্টার্ট করেন। 

ছিনতাইকারীর কথাই সবার একটু মায়া হল, সবাই থেমে গেল। 

আমি আরেকটু এগিয়ে গিয়ে ভাষণের স্বরে বলতে লাগলাম, ভাই সকল, মানুষ মানুষকে বাঁশ দিয়ে এভাবে মারতে পারে? ছিনতাইকারীরা কী মানুষ না? 

ছিনতাইকারী উঠে দাঁড়িয়ে আমার কথায় সহমত পোষণ করল, দ্যাখছেন ভাই দ্যাখছেন, কী মারাটাই না মারল। খালি আফনেই আমাদের মনের দুঃখ বুঝতে পারলেন। আফনে আমার মায়ের পেটের আপন ভাই। 

ছিনতাইকারীকে বললাম, আপনে চুপ থাকেন মিয়া, আমার কথা এখনো শেষ হয় নাই। আরেকটু বাকী আছে। জনতার উদ্দেশ্যে বললাম,সে ছিনতাই করেছে ভালো কথা, তাই বলে তাকে বাঁশ দিয়ে মারতে হবে? আশেপাশে কি রড ছিল না?

ছিনতাইকারী ছোট্ট একটা ঢোক গিলে সবাইকে বলল, ভাই সকল, যার কাছে যা আছে তা দিয়েই আমারে মারেন। কোনো সমস্যা নাই। ভুলেও ভাইয়ের কথা শুইনেন না। ভাই আমার আপনা লোক, ছিনতাই করে মাল ভাগ দেই নাই দেইখ্যা আমার পিছনে লাগছে। 

জনতার মধ্যে নবগুঞ্জন সৃষ্টি  হল। সবাই আমাকে ও হাসিফকে ভালো করে দেখে নিচ্ছে। ভয়ঙ্কর অস্বস্তি লাগছে আমাদের। কখন জানি উল্টো আমাদের ওপর হামলা করে বসে তার কোনো গ্যারান্টি নেই। জনতা, পুলিশ ও কুত্তা এদের বিশ্বাস করতে নেই। এদের দেখে দৌড় দিলেই বিপদ। আমি এ মূহুর্তে দৌড় দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না। দৌড়ের প্রস্তুতি নিয়ে হাসিফকে বললাম, বাঁচতে চাইলে এখই পালা বন্ধু। আমি দৌড়াচ্ছি, হাসিফ হাঁপাচ্ছে। জনতা আসল ছিনতাইকারীকে ছেড়ে দিয়ে আমাদের পেছনে ধর ধর করে দৌড়াতে শুরু করল। হাসিফ ভয়ে উষ্টা খেয়ে পড়ে গেল রাস্তায়। আমি ওরে জনতার হাতে সদকা করে দিয়ে দুই চোখ বন্ধ করে দিলাম দৌড়। বিপদের ঠিকঠিকানা নাই, কখন কার ওপর এসে পড়ে কে জানে! 

শেয়ার করুন

লেখকের সব লেখা
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments