মনে পড়ে— বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে সন্ধ্যার দিকে। পশ্চিম থেকে উড়ে আসছে একটা নাবালক কান্নার টাপুরটুপুর। জানালার গ্রিল বেয়ে জীবনের গল্প নিয়ে হেঁটে যাওয়া এক বাড়ন্ত মানিপ্ল্যান্টের সাথে বসে আছি। জানালার ওপাশে বহুমাত্রিক জীবনের অসংখ্য গল্প হর্ণ বাজিয়ে চলে যাচ্ছে৷ আমি নির্বিকার চেয়ে আছি। বাড়ির বাহিরে ঈদ করার মতো সুঠাম মানসিকতা তখনও তৈরি হয় নাই। চোখের তারায় বারবার শুধু ভেসে উঠছে একটা নিবিড় প্রেমের পরিপক্ব ছন্দ। যার একমাত্র সুরকার আমার মা।
—হ্যাঁ মা!
—কেমন আছো বাজান?
—ভালো, আব্বায় গরু কিনছে?
—হ, কিনছে তো!
—কি কালার গরু?
—সাদা কালো, তোর পছন্দ সাদা কালো এজন্য সাদা কালো গরু কিনছে, তুই আসবি কবে বাজান?
—ঈদের আগে আসা যাবে না, মানা করছে বড় হুজুর। হুজুর বলছে ঈদের দিন বিকালে ছুটি দিবে।
—আচ্ছা আব্বু মন খারাপ কইরো না, ঈদের দিন বিকালেই আইসো।
সেদিন ফোনের এপাশে প্রচণ্ড মন খারাপ নিয়ে কয়েক মুহূর্ত নিশ্চুপ থেকে লাইন কেটে দিয়েছিলাম। লাইন কাটার আগে আম্মুর ভারি নিঃশ্বাসের শব্দে আমার বুকের ভেতর আষাঢ়ের তুমুল বর্ষণ শুরু হয়।
মনে পড়ে— ঘুড়ি উড়ানো মুক্ত কিশোরের মতো বয়সে শূন্য আকাশ দেখে কাটিয়ে দিয়েছিলাম কতোগুলো দীর্ঘ বিকেল। সেইসব আবদ্ধ সময়ে পাখি হবার অনন্ত তৃষ্ণা নিয়ে বহু সকাল বারান্দার খোলা জানালায় দাঁড়িয়ে অনুযোগের সুর তুলতাম “খোদা! আমাকে কেন পাখি বানাইলা না!” উড়ে যাওয়া পাখিদের সুর ধরে বলতাম পাখির জীবনে কি স্বাধীনতা আছে! সকালের দলবেঁধে উড়ে যাওয়া পাখিকে দেখি শেষ বিকেলে কারেন্টের তারে নিঃসঙ্গতায় কাতরাচ্ছে— একা। তখন ক্লাসে ছুটি চলছিলো। ছুটির দুপুরগুলো যখন নিঃসঙ্গতায় হাহাকার করে উঠতো তখন আমরা শুনতাম বড়দের সংগ্রামের কথা। কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করতো তোমরা ইলমের সাধক হতে চাও? চিৎকার করে সবাই হ্যাঁ সূচক জবাব দিতো। ইলমের সাধক হবার তৃষ্ণায় পরিবার বিচ্ছিন্ন হবার মতো হৃদয়স্পর্শী গল্পে আমার নাবালক হৃদয় ভরে উঠতো। মহান মনীষীদের সংগ্রামের গল্পের গলি-ঘুপচিতে ঈদুল আজহার রক্ত খোঁজা এক বন্ধুকে দেখেছিলাম ঝাঁঝালো সম্বোধনে হুজুর বলেছিলেন তাদের থেকে অনুপ্রাণিত হও!
মনে পড়ে— দুপুরের কড়কড়ে রোদ, হিফজখানার বদ্ধ জীবন, অসম্ভব সব ইচ্ছেরা পায়রার মতো ডানা ঝাপটাতো সব সময়। অসীম বলতে বুঝতাম লম্বা বারান্দার শেষদিকে খোলা জানালা দিয়ে উঁকি দেওয়া আকাশের কিয়দাংশ! এখন সময় বদলেছে। ঈদুল আজহায় ঈদের আগের বাড়ি যাওয়ার উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞার প্রতি এক আকাশ অভিযোগ নিয়ে নির্ঘুম কাটিয়ে দেওয়া আমার ফ্যালফ্যালে একজোড়া চোখ— এখন কোমল স্মৃতি। এমন আরো কতো কতো কোমল স্মৃতি লাল নীল ফুল হয়ে ফুটে আছে—একদিন মনখারাপ দেখে হুজুর কাছে ডেকে বলেছিলেন এসব কষ্ট একদিন সুখ হবে। আব্বুকে ফোন দিয়ে অভিযোগ করার পরে বলেছিলো বড় হবার জন্য অনেক ত্যাগ করতে হয়।
আমার কৈশোরের সেইসব দিন এখন রঙিন স্মৃতি৷ আমার মনে চায় আরো একটা আবদ্ধ জীবন পেতাম যদি! যেখানে বাড়ি যাবার মিথ্যা বাহানা থাকবে, সুখ বলতে বুঝবো কেবল আম্মার আঁচল, কেউ আমাকে বড়দের গল্প শুনিয়ে মন খারাপ দূর করবে। কেউ আদুরে গলায় বলবে “এসব কষ্ট একদিন সুখ হবে”। সময়ের ক্যানভাসে আমার রঙিন স্কেচে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে জীবনের জটিল মেটাফোর। তবু মনে চায় একটা আবদ্ধ জীবনে মন খারাপ হোক। শিশুভুলানো গল্প শুনিয়ে কেউ বলুক “বড় হবার জন্য অনেক ত্যাগ করতে হয়”।