তাসাওউফ কখনো কখনো মৃত্যুর ভয় নফসের ধোঁকা

মূল : বদিউজ্জামান সাইদ নুরসি

নিজের সাথে নিজের পরিচয়
খুব কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সময় কাটছিল, মৃত্যভাবনা আমাকে অস্থির করে তুলছিল, আমার অধৈর্য নফস আমাকে কেবল পেরেশান করে যাচ্ছিল। ঠিক ওই সময় কিছু ভাবনা আমার নফসকে শান্ত করে, নিজের প্রতি নিজের ভালোবাসা ফিরিয়ে আনে এবং আমি আবার আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া আদায় করি। আমাকে শান্ত করা সেইসব ভাবনা চিঠির (রিসালায়ে নুর) মাধ্যমে আপনাদের সামনে উপস্থাপন করছি—এই আশায় যে, হতে পারে এসব ভাবনা আপনাদের জন্যও উপকার বয়ে আনবে :
প্রথম ভাবনা : ওরে নফস, তুই তো দুনিয়ার যত মজা আছে তার নিরানব্বই ভাগই ভোগ করে ফেলেছিস, তাই এখন আর অল্প ঝাল তোর কাছে ঝাল লাগে না, তুই আরও ঝাল চাস—দুনিয়ায় আরও মজা চাস।
দ্বিতীয় ভাবনা : তুই চাস দুনিয়ার মজা চিরস্থায়ী আর চির-অপরিবর্তনীয় থাকুক, অথচ দুনিয়া অনিত্য ও ধ্বংসশীল। একারণে এক মিনিটের হাসির ক্ষতিপূরণ হিশেবে তোকে দশ ঘন্টা কাঁদতে হয়।
তৃতীয় ভাবনা : যেসব দুর্যোগ-দুর্গতি আর বালা-মসিবতে তুই কাবু হয়ে গেছিস, সবই তকদিরের আদালতের ফয়সালা। লোকে তোকে বিনা অপরাধে শাস্তি দেয়, জুলুম করে—এর কারণ তকদির তোর গোপন গোনাহের জন্যে এ ধরনের মসিবতে ফেলে তোকে আদব-কায়দা শেখাচ্ছে, তোর ভুলের কাফফারা দিচ্ছে।
চতুর্থ ভাবনা : ওরে অস্থির নফস, তুই নিজের শত-সহস্র অভিজ্ঞতার আলোকে এই বিশ্বাস পর্যন্ত পৌঁছে গেছিস যে বাহ্যিক বিপদ-আপদ আর তার পরিণতি পরিশেষে সীমাহীন আনন্দ সহকারে আল্লাহর সাহায্য হয়ে আসে। আল্লাহ পাক বলেন—
وَ عَسٰۤی اَنۡ تَکۡرَهُوۡا شَیۡئًا وَّ هُوَ خَیۡرٌ لَّکُم
হতে পারো কোনো জিনিস তোমরা অপছন্দ করছো অথচ তাতে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে। (সুরা বাকারা, আয়াত ২১৬)
এই আয়াত পরম বাস্তবতার শিক্ষা দেয়। কোরআনের এই শিক্ষা সব সময় মনে রাখবি। আল্লাহর নিয়ম—যা জগৎ-সংসারে চক্রাকারে ঘোরে—এই প্রশস্ত বিস্তৃত ও মহামহিম তকদিরের নিয়ম তোর স্বার্থে পরিবর্তন হতে পারে না।

নফসে আম্মারায়ে সানি
একবার আমি চিন্তা করে দেখলাম : নফসে আম্মারার পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত অনেক ওলি-আউলিয়াও কঠোর মোজাহাদা করেন এবং বারংবার নিজের নফসে আম্মারার বিরুদ্ধে নালিশ করেন। আমি খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই, পরে দীর্ঘদিন চিন্তাফিকির করার পর বুঝতে পারি নফসে আম্মারা ও তার যোগাযোগ ছাড়াও ছায়ার মতো আরেকটি নফসে আম্মারা আছে। এর নাফরমানি, বিদ্রোহী মনোভাব ও আল্লাহর আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার চাহিদা নফসে আম্মারার চেয়ে বেশি। সে সর্বক্ষণ চরিত্রের মন্দদিকটা সামনে ঠেলে দেয়। তাকে নফসে আম্মারায়ে সানি (দ্বিতীয় নফসে আম্মারা) বলা হয়। এই নফস কুপ্রবৃত্তি ও মন্দ স্বভাবকে বিজয়ী বানাতে সব সময় তার যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে এবং তার চলাচল মানুষের রগরেশার সর্বত্রই। এই নফসই শেষ কেল্লা—যেখানে নফসে আম্মারা আশ্রয় নেয়। এই কেল্লা থেকেই আত্মশুদ্ধিকামী নফসকে ঠেকানোর জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়, নফসে আম্মারার ‘অসমাপ্ত’ কাজ সমাপ্ত করার দায়িত্ব এখান থেকেই পালিত হয়, এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই কেল্লার কার্যক্রম জারি থাকে।
এর পরে আমি বুঝতে পারি আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ প্রকৃত নফসে আম্মারার বিরুদ্ধে না, বরং নালিশ করেন এই রূপক নফসের বিরুদ্ধে। তারও অনেক পরে আমি ইমামে রব্বানি মোজাদ্দেদে আলফেসানি শায়খ আহমদ সিরহিন্দির লেখাতেও এই রূপক নফসে আম্মারায়ে সানির বিষয়টি পাই।
এই নফসে আম্মারায়ে সানির চাহিদা যেহেতু অন্ধ ও অনুভূতিশূন্য, তাই সে মস্তিষ্কের কথা কানে নেয় না, কলবের নসিহত সে মানতে রাজি না। সে যেহেতু শুনেই না, তাই সে ঠিক হতে পারে না, নিজের কমতিও ঠাহর করতে পারে না, আর সে কেবল তখনই সঠিক পথে ফিরে আসে যখন বিপদ-আপদের মাধ্যমে জোরে থাপ্পড় খায়, অথবা নিজেকে পুরোপুরি কোরবান করে দেয়। মানুষ আপন লক্ষ্য পৌঁছুতে যখন প্রবৃত্তির চাহিদাকে বিসর্জন দেয়, এবং শুধু আমিত্বকেই নয়, নিজের সবই আল্লাহর পথে উৎসর্গ করে দেন—যেমনটা রিসালায়ে নুরের ছাত্রগণ করে থাকেন—তখনই কেবল এই নফসকে শুধরানো সম্ভব।
এই দুঃসময়ে প্রকৃত ও রূপক—দুই ধরনের নফসে আম্মারাই মানুষকে হেদায়াতের পথ থেকে বিচ্যুত করতে একজোট হয়, তারপর জোরে ধাক্কা মেরে এমনসব অপকর্ম আর গোনাহের কাজে ঠেলে দেয়—যেসব কাজের পরিণাম ভেবে পুরো মহাবিশ্ব আতঙ্কে কেঁপে উঠে।
এমনকি আমি (এই নফসের খপ্পরে পড়ে) এক মুহূর্তের জন্য এবং খুবই সামান্য কারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ সওয়াবের কাজ থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিয়েছি।
আর এই ঘটনা মা’নাওয়ি মোজাহাদার (ভাব-সাধনা) সময় দশ মিনিটের মধ্যে ঘটে গেছে। এই সময় আমার সৈন্যবাহিনী থেকে একজন দুশমনের বাহিনীতে এমনভাবে ঢুকে পড়ে, যেন নিজেই আস্ত এক বোমা, যে একের পর এক গোলা ছুঁড়ে শত্রুকে নাজেহাল করে দিচ্ছে। তখন আমার দুই নফসে আম্মারা আমাকে আলস্যের ঢপ দিয়ে সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে আমাকে কাবু করে ফেলে। যখন আমি সচকিত হই, নিজেকে বলি—আমি শোকরগুজার ও কৃতজ্ঞ হওয়ার বদলে কেন হিংসা ও লোক দেখানোর মতো ঘৃণ্যকাজ করছি, কেন এহেন অন্ধকারকে আপন করে নিচ্ছি? তাৎক্ষণিক বলে উঠি, ‘কেন আমি বোমা নিক্ষেপ করলাম না?’
আল্লাহর প্রতি হাজার হাজার শোকর, রিসালায়ে নুর—বিশেষ করে এখলাস বিষয়ে লেখা চিঠিগুলো—আমার ওই দুই নফসের সব চক্রান্ত নস্যাৎ করে ফেলে, আর তাদের আঘাত করা জখমে দাওয়াই লাগিয়ে দেয়। এভাবেই রিসালায়ে নুর তাৎক্ষণিক আমার দুরবস্থার লাগাম টেনে ধরে।
ঠিক ওই সময় আমার নিজের মাঝে নিজের কমতির উপলব্ধি জন্মে। এক্ষণে ওই কমতির কথা বলছি—যা চোখে দেখা যায় না, এবং এই কমতির কারণেই যেকোনো মুহূর্তেই আপতিত হতে পারত আল্লাহর আজাব ও মসিবত, কিন্তু আল্লাহর দয়ায় সেখান থেকে মুক্তি পেয়েছি।

নফসের সাথে আলাপন
আমার প্রিয় বিশ্বস্ত ভাইয়েরা, আমি মনস্থ করেছি—সতর্ক করবার জন্যে নফসের সাথে আমার আলাপন হুবহু আপনা্দের সামনে তুলে ধরব। আমাদের আলাপ ছিল অনেকটা এমন :
আমার মাথার উপরে ঝুলে থাকা বিধির বিধানের মতো আপনারা সবাই জানেন—নফসে আম্মারাকে আমি সবসময় চুপ করিয়ে রাখি, বিভিন্ন দলিল-প্রমাণ দিয়ে তার মুখে তালা মেরে রাখি। কিন্তু এক রাতে আমি অন্ধ প্রবৃত্তির লাগাতার হামলায় কাবু হয়ে পড়ি, সে নফসে আম্মারা থেকে অস্ত্রসহায়তা নিয়ে আমাকে আক্রমণ করেছিল। এই জোরালো আক্রমণে আমার সমস্ত রগরেশায় ভয়ানক প্রভাব পড়ে, আমি তো এমনিতেই অসুস্থ, বালা-মসিবত আর শয়তানের ওয়াসওয়াসা সব সময় পিছু লেগে আছেই, এর মধ্যে এই ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ আমাকে একদম ধরাশায়ী করে ফেলে।
তো পরিস্থিতি এমনই ছিল—অন্ধ প্রবৃত্তি আর কামনা আমার কলব ও রুহকে এমনভাবে ধাওয়া করে, মনে হচ্ছিল মৃত্যু কিংবা পার্থিব জীবনকে ‘বিদায়’ বলার সময় হয়ে গেছে। এই আক্রমণ আমার মর্মে সর্পসম মত্ত আশা, গভীর দুঃখবোধ আর বেঁচে থাকার প্রতি তীব্র লালসার জন্ম দেয়; একই সাথে এই অনুভূতি আমার মাঝে বিপদ-আপদ ও সব হারিয়ে ফেলার ভয় তৈরি করে। এরই সুযোগে দ্বিতীয় নফসে আম্মারা শয়তানের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে বলে :
‘তুই নিজের জীবনটাকে এক চিমটি সুখ বা একটুখানি আরাম-আয়েশও দিতে চাস না কেন? বরং এর উল্টোটা করার জন্য সবরকমের চেষ্টা-তদবির করে যাচ্ছিস। তুই তো রিসালায়ে নুরের খেদমত করার পাশাপাশি সব করতে পারিস; তোর মনের মতো একটা নিশ্চিন্ত আর ঝুট-ঝামেলাহীন জীবন পার করতে অসুবিধা কোথায়? অথচ তুই কিনা ভাবিস শুধু মরণের কথা। মৃত্যু কেন তোর এত পছন্দ?’
ঠিক ওই মুহূর্তে আচমকা আমার সামনে দু’টো হাকিকত স্পষ্ট হয়ে যায়, আর একই সাথে নফসে আম্মারায়ে সানি ও শয়তান বোবার মতো নিশ্চুপ হয়ে যায়।

প্রথম হাকিকত : যখন আমার মৃত্যুর কারণে রিসালায়ে নুরের পবিত্র কাজ আরও ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়বে, আরও বিশুদ্ধভাবে এর দাওয়াতি কাজ আঞ্জাম দেওয়া হবে, তখন কোনোদিক থেকে এ-অভিযোগ আরোপ করা সম্ভব হবে না—এই খেদমত দুনিয়াদারির খাতিরে, আমিত্বের জয়গান কিংবা আত্মতুষ্টির জন্য করা হচ্ছে। আর এভাবেই এই ঈমানি ওজিফা আরও বেশি এখলাসের সাথে পরিপূর্ণতার পথে গতিশীল হবে। কেননা ওই সময় হিংসুকেরা আমার ওপর হিংসার অনল বিচ্ছুরণ করার কোনো কারণ পাবে না।
যদিও আমার জীবদ্দশায় এই খেদমত কিছুটা হলেও বেগ পাবে, আমার তরফ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা হবে, তবু আমার সাদাসিধে ব্যক্তিত্বের ওপর হিংসা আর সমালোচনার ছুরি চালাবার মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ আছে, যাদের পাশ কাটানো আমার জন্য মুশকিল। এ ধরনের লোকের মধ্যে আমার ব্যক্তিত্বের ওপর মিথ্যা অভিযোগ লাগানো, আমাকে সমালোচনার পাত্র বানানো, কিংবা রিসালায়ে নুরের এখলাস নিয়ে প্রশ্ন করা, এর থেকে মানুষকে দূরে রাখার প্রবণতা থাকবেই, তাদের চোখ বন্ধ করে এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব।
কোনো এলাকায় যদি চৌকিদারের দায়িত্ব বেড়ে যায়, দিন-রাত তার নির্ঘুম কাটাতে হয়, একা পুরো এলাকা যদি সামাল দিতে না পারে, তাহলে সতর্ক ও সচেতন এলাকাবাসী অবশ্যই বিছানা থেকে উঠে আসবে, এবং একজন চৌকিদারের জায়গায় তখন হাজার হাজার চৌকিদার বসবে।
একইভাবে আমার প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে মৃত্যুকে ‘আহলান সাহলান’ (স্বাগত) জানানোই সঠিক কাজ হবে।
ওরে নফস, তুই চেষ্টাশ্রম আত্মদান কিংবা নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার প্রশ্নে কেন এখনও রিসালায়ে নুরের ছাত্রদের পিছনে পড়ে আছিস, যারা ‘নুরের’ খেদমতে নিজের সব সহায়-সম্পদ আরাম-আয়েশ কিংবা দুনিয়ার সবধরনের সুখ বিসর্জন দিতে কার্পণ্য করে না, এবং ক্ষেত্রবিশেষ জীবনও কোরবান করে দেয়।
ওরে মন, খুব ভালো করে মনে রাখিস, এই ক্রমবর্ধমান কষ্ট-সংকটের দুনিয়ায় অসহায় ও ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ যখন বেঁচে থাকার তাগিদে মাঝদরিয়ায় খড়কুটোর আশ্রয় খুঁজবে, তখন এই রিসালায়ে নুর শক্ত পাটাতন হয়ে তাকে হেদায়াতের পথ দেখাবে।
তাই রিসালায়ে নুরের স্বার্থে এই জীবনকে সানন্দচিত্তে ‘বিদায়’ বলা বড় সম্মানজনক কাজ হবে।

দ্বিতীয় হাকিকত : একজন অসহায় ও দুর্বল ব্যক্তি—যিনি এক কেজি ওজনের বোঝা বহন করার শক্তি রাখেন না, ঘটনাক্রমে তার কাঁধে যদি দশ কেজি ওজনের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়, আর তার এক আপনজন সহায়তা করার বদলে উল্টো তার কাছে সহায়তা প্রার্থনা করে, (কারণ ইতোপূর্বে তিনি কখনও নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করেননি, আর তাই তাকে খুবই শক্তিশালী ভাবা হতো।) এরকম পরিস্থিতিতে ওই দুর্বল ব্যক্তি নিশ্চয় নিজেকে সবল দেখানোর চেষ্টা করবে, যেন তার চোখ থেকে পড়ে না যান, এবং তার সুধারণা বহাল থাকে। কিন্তু এই কাজ করতে গেলে তাকে কৃত্রিম শক্তিমত্তা দেখাতে হবে, দুর্বল হয়ে সবলের অভিনয় করতে হবে, কিন্তু তার আবার এই ধরনের অপ্রিয় কাজ করার গুণ নেই।
ঠিক এই ভাবেই—ওহে আমার অন্ধ প্রবৃত্তি ও কামনার মাঝে লুকিয়ে থাকা দ্বিতীয় প্রকারের নফসে আম্মারা—মনে রেখো : পবিত্র কোরআনের ল্যাবরেটরিতে আবিষ্কৃত তত্ত্ব—যা রিসালায়ে নুরের রূপ পেয়েছে এবং আত্মার অন্ধকার ও হৃদয়ের রোগ দূর করে সেখানে আল্লাহর ফজল ও রহমতের আলো ছড়িয়েছে—নিশ্চয় এসব তত্ত্ব আমার নিজের নয়। আমি তো অতিশয় দুর্বল ও অসহায়, অক্ষম ও মুখাপেক্ষী, এবং কোরআনের চৌকাঠে আশ্রয় প্রার্থী একজন সাধারণ মানুষ। আমি কেবল আল্লাহর বাণী আল্লাহর বান্দা পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার একটি ওসিলা। …কিন্তু বিশুদ্ধ মনের রিসালায়ে নুরের ছাত্রগণ, আমার প্রকৃত বন্ধু ও আত্মোৎসর্গী ব্যক্তিবৃন্দ আমার দুর্বলতা সত্ত্বেও সবল মনে করে, আমি যতটুকু ভালো গুণ রাখি—তারা এর চেয়ে হাজার গুণ বেশি আমার প্রতি ভালো ধারণা রাখে।
এই কারণে আমি চাই না তাদের ভালো ধারণা নষ্ট হোক, তাদের অনুভূতিতে আঘাত পড়ুক, এবং ‘নুর’ অর্জনের উৎসাহ-উদ্দীপনা মাঠে মারা যাক। আর তাই যারা আমাকে ‘ওস্তাদ’ বলে ডাকে, তাদের থেকে দূরে সরে গিয়ে ঘৃণার পাত্র হতে চাই না। আমি মানুষের সাথে সাক্ষাৎ করি না, রুহানি নির্দেশে সাক্ষাৎ-পরিচয়ের কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছি; কারণ দীর্ঘ বিশ বৎসর নিঃসঙ্গ জীবন কাটানোর ফলে আমার ভেতরে ‘বিতৃষ্ণ’ মনোভাবের উন্মেষ ঘটেছে, একারণে আমি রিসালায়ে নুরের কাজের সাথে সম্পৃক্ত খুব গুরুত্বপূর্ণ বন্ধুদের ছাড়া অন্যান্য বন্ধুদের সাথে সাক্ষাৎ করাও ছেড়ে দিয়েছি। আমার তাই ভান করা সম্ভব না, আর এমন কিছু প্রকাশ করি না যা আমার ব্যক্তিত্বের বাইরে। এবং তাদের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করি না যারা আমার ব্যাপারে অতিরিক্ত ভালো ধারণা রাখে; আমি যে অবস্থানের যোগ্য নই, আমাকে সেই অবস্থানে বসায়। আমি অহঙ্কার ও গর্ব থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করি, যেই মন্দ গুণ সরাসরি এখলাসের সাথে সাংঘর্ষিক, এবং পুরোপুরি নিষিদ্ধ। এবং সম্মান ও মহানত্বের আড়ালে লুকিয়ে থাকা আমিত্ব ও বড়ত্বের গুণকেও শক্তহাতে দমন করি।
ওরে আমার ‘অহঙ্কারের মজা পেতে মরিয়া’ নফস, আমার অবস্থা কী তোর আগ্রহ নষ্ট করতে পারবে না? ওরে আমার নফস, ওরে মজার দাস, ওরে হতভাগা অনুভূতি, ওরে প্রবৃত্তির পূজারী! তুই যদি সব রকমের, দুনিয়ায় যত রকমের আরাম-আয়েশ বা সুখদায়ী আসবাব আছে সবই পাস, সবকিছুর স্বাদ গ্রহণ করিস, তবু তুই নিজ অবস্থায় সুখী হতে পারবি না, সুখের সাগরে হাবুডুবু খেয়েও তুই দুঃখী থাকবি।
আমার নব্বই ভাগ বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয় ইন্তেকাল করেছেন। আমার মনে হয় তারা আমাকেও তাদের সঙ্গ দিতে আলমে বরযখে ডাকছে। এই জন্য বাকি দশ ভাগ বন্ধু থেকেও আমি নিজেকে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছি, বিশেষ করে বৃদ্ধকালের এই একাকিত্বে—কারণ আমার কাছে জীবনের চেয়ে আলমে বরযখ হাজার গুণ ভালো।

আর এই দুই হাকিকত আমার দ্বিতীয় নফসে আম্মারাকে একদম খামোশ করে দিয়েছে। আল্লাহ তাআলার প্রতি অসংখ্য শুকরিয়া, সমস্ত প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা কেবলই তারই জন্য—রুহের দাবি ও কলবের মিনতিতে আমার নফস নিজ অবস্থান থেকে সরে গেছে, আর শয়তানও চুপ হয়ে গেছে। ফলে আমার রগরেশায় থাকা রোগও দুর্বল হয়ে পড়েছে, আর আমিও এখন কিছুটা হালকা বোধ করছি।

গন্তব্য আলমে বরযখ
যদি আমি মরে যাই, তাহলে রিসালায়ে নুরের কাজ আরও বেশি এখলাসের সাথে মানুষের সামনে আসবে; কেননা ওই সময় না হিংসুক থাকবে আর না অভিযোগকারী।
তারপর ওরে নফস, তুই এই বছর একবারের জন্য অতীতের দিকে তাকিয়েছিলি, পুরনো দিন নিয়ে ভেবেছিলি—তাদের দেখার জন্য, যাদের দেখার জন্য তুই আর তোর রুহ ও কলব পাগল হয়ে ছিলি। যে শহরে তুই জীবনের বড় এক অংশ পার করেছিস, সেই শহরে তুই ওইসব বন্ধুর সাক্ষাৎ পেতে গিয়েছিলি—যাদের সাথে দীর্ঘকাল কাটিয়েছিস। ওইসব ভাইয়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলি যাদের বিচ্ছেদ তোকে দুঃখে মুহ্যমান রেখেছিল। কিন্তু ওই প্রিয় শহরে গিয়ে তুই কী দেখলি? তাদের দু’চারজন ছাড়া এখন আর কেউ বেঁচে নেই, সবাই আলমে বরযখে চলে গেছে। জীবনের ওই সময় যখন আনন্দ-উল্লাসে ভরপুর ছিল, তা এখন দুঃখ-দুর্দশায় পালটে গেছে। এজন্য প্রেমহীন এই পৃথিবীর এই মাটি না আমার কখনও উদ্দেশ্য হতে পারে আর না হতে পারে লক্ষ্য। এই জন্য, দুনিয়া কর্তৃক আমাকে বিতাড়িত করার আগে আমারই এই দুনিয়াকে বলা উচিৎ—‘আমার কাছ থেকে দূর হও’। দুনিয়াকে আমরা সসম্মানে বলি—‘বিদায়, ফি আমানিল্লাহ।’
জি হাঁ, আমাদের এভাবেই আত্মসম্মান রক্ষা করে এই ধ্বংসশীল দুনিয়া আর দুনিয়াদারির মজা ত্যাগ করা উচিৎ।

শেয়ার করুন

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments