কয়েকটি তুলনামূলক অসম্ভব

দুপুর হলেই আমি নৌকায় চড়ে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকি। গগণফাটা রোদের প্রতি আমার কি এক মোহাব্বত কাজ করে। আমার তলে পৃথিবী দোলায়মান৷ নদীর জল কখনো বৃহৎ পরিসর নিয়ে ধীরে ধীরে বৃত্তাকার ঘোরে, কখনো উঁচা-নিচা হতে হতে সমান্তরাল বয়ে যায়। পানিগুলা যে আকার ও গতিতে নড়ে নীলখটকটে আকাশও সেভাবে নড়ে, সমান্তরাল বা গোলাকার।

কতদিন ধরে দুপুরবেলা আমি এই কাজটি করে আসছি জানি না। কতক্ষণ ধরে এভাবে চিৎ হয়ে ভাসতে থাকি খেয়াল করি নাই৷ প্রায়শই আকাশে একটি বিশাল গাঙচিল ওড়ে এবং তাকে ঘিরে ছোটছোট কিছু পাখি বৃত্তাকারে ওড়ে। আমিও নৌকায় শুয়ে নদীঘেঁষে থাকা সুরম্য প্রাচীন বাড়িটি ঘিরে ভাসি। বাড়িটির সমস্ত শরীরজুড়ে এখানে ওখানে দেয়ালাংশ ধ্বসে পড়েছে। দিনের পর দিন নৌকায় চিৎ শুয়ে থাকি, দৃষ্টির উপরে ঝুলে থাকে অবিচল শূন্যস্থান, এটার উপর দিয়ে কত দুর্দম বাতাস দ্রুত বয়ে গেছে, সাথে আমার চিন্তা ও স্মৃতির কতকিছু উড়িয়ে নিয়ে গেছে। ঠিক কোন ঘটনার কারণে আমি ভাসা শুরু করছিলাম অনেকটাই ভুলে গেছি। যদ্দূর মনে পড়ে এই বাড়িটি থেকে একটি মেয়ে হারিয়ে গেছিল। তার নাম মনে পড়ে না। আমি তাকে তীব্র ভালোবাসতাম। প্রেম নিয়ে মানুষ অনেক এস্থেটিক আলাপই দিয়ে থাকে, যেগুলি অর্থহীন। আমি মনে করি যে নারী-পুরুষ মূলত দ্বান্দ্বিক চরিত্র। একে অপরকে মৌলিকভাবে চায় না, তবে অপরের পাত্তা পেয়ে আপন সত্তার অন্যকে মুগ্ধ করার কতটুকু যোগ্যতা আছে সেটা যাচাই করে দেখতে পছন্দ করে। মেয়েটি আমাকে চাইত না, তবে সে মনোজাগতিকভাবে আমার পাত্তা পেয়ে নিজের আকর্ষণ করানোর ক্ষমতা যাচাই করে দেখতে তুমুল আগ্রহ পেত। মেয়েটি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আমাকে স্বীকার করত, পরক্ষণে সেখানে দাঁড়িয়েই মুখের উপর আমাকে না করতে পারার মারাত্মক সাহস রাখত। তার এই ব্যাপারটিই আমাকে জেদ ধরিয়েছিল যে তাকে বশে আনবই।

যাই হোক। তো নৌকায় ভাসি এবং এই বাড়িটি ঘেঁষে ভাসতে ভালো লাগে। ভাসার উদ্দেশ্য মেয়েটির স্মৃতিই কেন্দ্র করে কিনা জানি না। বাকি এখানে ভাসার কর্মটি আমার ভালো লাগে। অজানা ভালো লাগে।

একদিন ভাসতে ভাসতে লক্ষ্য করি গাঙচিলের কিছুটা নিচ বরাবর ছোট ছোট পাখিগুলির বৃত্তাকারে ওড়ার দৃশ্যটি। গাঙচিল সহসা আক্রমণ করে তার থেকে সবচেয়ে দূরে অবস্থিত পাখিকে। দূরে থাকার কারণে গাঙচিল পৌঁছার আগেই শিকারটি উড়ে যেতে সক্ষম হয়। গাঙচিলের কাছাকাছি থাকা পাখিগুলি আরো আগেই উড়ে যায়। আমি ভাবি গাঙচিল তার চাইতে সবচেয়ে কাছের পাখিগুলিকে আক্রমণ করলো না কেন। পরে বুঝলাম যে তার বিশাল দেহের নিচে থাকা কাছের পাখিগুলির দিকে তার দৃষ্টি সহজে যায় না। তার দৃষ্টির লেন্সই দূরবর্তী। ফলাফলটা এমন দাঁড়ায় যে গাঙচিলের দূরবর্তী লক্ষ যেমন অসম্ভব, সেই অসম্ভবের তুলনায় কাছের লক্ষ্যগুলি আরো অসম্ভব।

দৃশ্যটি আমার মন খারাপ করে দেয়। এটাকে আরো অন্যভাবে ব্যাখ্যা করার কথা চিন্তা করি। কিন্তু মন আরো ঘোলা হয়, আকাশটাও ঘোলা হয়। বাতাসে অশুভের ধ্বনি। পাখিগুলা দৌঁড়ঝাপ শুরু করে। নড়বড়ে নৌকা বাতাসে প্রায় উড়ে যায়। আমি অনেকগুলা পানি খেয়ে হুঁশ হারিয়ে ফেলি। সন্ধ্যায় তীরে নিজেকে আবিষ্কার করি এবং মেয়েটি আমাকে কোলে করে রেখেছে। মেয়েটি পথে হাঁটতে হাঁটতে অনেক গল্প বলে থাকবে। আমার কানে কিছু ঢোকে নাই। আমি ছিলাম বিহ্বল। মেয়েটি একটি চিপা গলির শেষ মাথায় একটি বাড়িতে ওঠা শুরু করে। আমিও তার সাথে সিঁড়ি বেয়ে উঠি। আমি বলি তুমি এখানে থাকো? সে বলে, নাহ আমার বাড়ি নাই! এটা আমার প্রতিষ্ঠান, এখানে পড়াই। আমি বলি তোমার বাড়ি লাগে না? সে বলে, নাহ লাগে না। এটাই আমার বাড়ি! মেয়েটি আমার ঠোঁটে হামলে পড়ে। আমার কাছে চুমা খাওয়া একটি অতর্কিত ঘটনা যেন একটি আস্ত প্রাণ ঢেউ খেলে মুখের উপর আছড়ে পড়ছে। ওর হৃদয়টা ছলকে পড়ছে আমার চোখে, মৃদু আঘাতে চোখ মুদে আসছে অথচ আমি মেয়েটির হৃদয় পূর্ণ আলোয় দেখতে পাচ্ছি। মেয়েটি গলা পেতে দেয় আমি চুমুক লাগাই। ওর স্তনের ভাঁজ পর্যন্ত নেমে যাই, আহ আমার থুতুর গন্ধও এখানে মাদক হয়ে ওঠে যে! ওর তালের মতো স্তন আমি আঁকড়ে ধরি। সে গোঙরায় কিনা বুঝতে পারি না। সে আমাকে জোর করে ছাড়াতে সক্ষম হয়! আমি বলি, তোমার নামটা কী জানতে পারি? সে বলে আমি তোমার ফান্দাস.. আমি সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাই..

আমার মাথায় গাঙচিলের ব্যর্থ হওয়ার দৃশ্যটি আঘাত করছে অনবরত। এটা কি মারাত্মক একটা ব্যাপার? এটার ব্যাখ্যা খোঁজার তাড়না বেড়েই চলছে। আমি যতটুকু ব্যাখ্যা করেছি তারচেয়ে বেশি ভাবতেও পারছি না। নৌকায় শুয়ে ভাসতে ভাসতে কয়েকদিন আমি এটাই ভাবতে থাকি।

আমি নৌকায় শুয়ে ভাসার কাজটি বাদ দেই না। নিয়মিতই ভাসি। যদিও আমি জানি যে ফান্দাস এই এলাকায় থাকে না।

পরে অবশ্য ফান্দাসের সাথে একবার মোলাকাত হয়েছে, গাঢ় অন্ধকার এক সন্ধ্যায় বৃষ্টি থেকে বাঁচতে আমি দৌড়াচ্ছিলাম, সহসা দেখি এক ছায়ামানবী ভাবলেশহীন ভিজছে বা পাগলীর মতো হাঁটছে। আমি তার অবস্থানের রাস্তাঘাটগুলি মনে রাখতে পারি না। রাস্তাঘাট মনে রাখা আমার জন্য কষ্টকর একটি বিষয়। আমি আয় রোজগােরের কথা ভাবি। ফান্দাসকে নিয়ে একটি ছোট্ট ঘর বাঁধার প্রয়োজনবোধ থেকেই বিষয়টি নিয়ে কিছু কিছু ভাবি। ফান্দাসের কাছে আমার ‘ঘর লাগে না’ শোনার পর থেকে আমার কাছে মনে হওয়া শুরু করে যে ঘর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে থাকবে। আমি মারাত্মক একটি ঘোরে চলে যাই, যেখানে শুধু ইয়াঝিদ ফাহাদের একটি লাইন বাজে, ‘ উরিদু মানঝিল মায়া মান আখতার। জান্নাতুন সাগিরা, লি অ লিমান উহিব্ব। উরিদু মানঝিল, লা হুঝনা ফিহ। ’

আমি একটি ইট ভাঙার কাজ পাই। পাথরের উপর ইট রেখে হাতুড়ি দিয়ে ইট ভাঙি। কাজটা মিউজিক্যাল। ঠিপ ঠিপ শব্দের দারুণ শৃঙ্খলে কামে জোশ পাই। ইট ভাঙার শব্দ-তাল ইয়াঝিদ ফাহাদের ‘আনা’ গানটির তালের সাথে অনেকটাই মেলে। এই কাজটা স্থায়ীভাবে করা যায় না। ইট ভাঙা সমিতি জানিয়েছে যে একমাস কাজ করার পর যারা ভালো করে তাদেরকে বিভিন্ন কাজের প্রমোশন দিয়ে দেওয়া হয়। যেমন লন্ড্রির কাজ, রাজমিস্ত্রির কাজ, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের তদারকি, বিকাশের ইনফ্লুয়েন্সার হওয়া ইত্যাদি। আর যারা ভালো করতে পারে না তাদেরকে ইট ভাঙার কাজ থেকে ইস্তফা দিয়ে নতুন শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়।

কাজ শুরু করার পর থেকে আমার মধ্যে বেশ কিছু অবস্থার সৃষ্টি হয়। নৌকায় ভেসে বিভিন্ন দৃশ্য খোঁজার কাজটি অনিয়মিত হয়ে যায়। স্মৃতিশক্তি বেশ কমে আসে। দৃশ্য খোঁজার আগ্রহও অত পাই না। অথবা দৃশ্যের প্রতি আগ্রহ কমাই স্মরণশক্তি হ্রাস পাওয়ার কারণ হয়ে থাকবে, ঠিক জানি না আমি।

এখানে যেটা ঘটেছে যে ফান্দাস ও ছোট্ট ঘর বাঁধা কেন্দ্র করে রোজগারে নেমেছি এবং ভেবেছি যে কাজটায় অভ্যস্ত হয়ে উঠলে আমি দৃশ্যগুলি নিয়ে আবারও কাজ করার ফুরসত পাব। অথচ দিন দিন আমি দেখি ইট ভাঙার কাজটি আমার অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। একমাস পর প্রমোশন না পাওয়ারই সম্ভাবনা। কাজে ঢোকার আগে কাজ সংশ্লিষ্ট পরবর্তী পরিস্থতিগুলা আমি বিস্তারিত জানতাম না। নতুন কোনো কাজের চিন্তা আমাকে সারাক্ষণ উদ্বিগ্ন করে রাখছে। অন্যদিকে লোকেরাও আগ্রহভরে আমাকে বসায় না, আমার দৃশ্যগুলি শুনতে চায় না। দৃশ্য ব্যাখ্যার জন্য মজলিশের আয়োজন করে বসার প্রয়োজন পড়ে , শান্ত ফুরফুরা বৈঠকি মেজাজ লাগে, কাজের চাপে অত সময় বের করা যায় না।

দৃশ্য ব্যাখ্যার আগ্রহ কমে যাওয়া আমার জন্য একটি কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। মনের সমস্ত আনন্দ হারিয়ে ফেলি। আমার ভিতর থেকে আবিষ্কারের সত্তা হারিয়ে যেতে লাগে, বিস্মৃতির গভীর গর্তে পতিত হতে থাকি।

একদিন উদ্ভ্রান্ত পাগলের মতো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে এক যুবকের সাথে ধাক্কা খাই। যুবকটি বলে, আরিশ শালা কতদিন পর দেখা হইল! আমি বলি, আপনাকে চিনতে পারলাম না তো। সে বলে, কেন আমরা তো একসাথে পড়লাম, কত বিকালে কত চা খাইলাম আর আড্ডা দিলাম ভুইলা গেলা সব!? আমি বলি, দুঃখিত আমি আপনাকে স্মরণ করতে পারছি না। চলেন বসে চা খাই।

যুবকটি আমাকে একটি পানশালায় নিয়ে যায়। এখানে সব চিকন চিকন তরুণ বসে কিসব আলাপ মারছে। যুবকটি আমাকে বসিয়ে পূর্ণ একবেলা ধরে স্মরণ করানোর চেষ্টা করে আমরা কিভাবে বন্ধু ছিলাম এবং লেখাপড়ার যমানায় ঘটা এটাসেটা ঘটনা বর্ণনা করে শোনায়। আমি বলি, আপনি হয়ত আমার বন্ধু হয়ে থাকবেন। আপনার বলা ঘটনাগুলি আমি পুরাপুরি স্মরণ করতে পারছি না। এতটুকু মনে করতে পারছি যে আমি কোনো জামেয়ায় পড়তাম আর সেখানে আপনি আমার বন্ধু হলেও হতে পারতেন।

সে একনাগাড়ে বকেই যায়। আমি নীরবতা পালন করি। কিছু কিছু ব্যাপার মনে করতে পারছি। আমাকে ওই জামেয়া থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। এরপরে দিনে দিনে এটা আমি উপলব্ধি করেছিলাম জামেয়ায় যা কিছু জ্ঞান অর্জন করলাম এগুলি আমার কোনোই কাজে দিবে না। এলেমগুলি আমার নফসের জন্যে কার্যকরী হলেও কেউ এগুলি আমার কাছে শিখতে আসবে না। আমার জ্ঞান অর্জনের দীর্ঘ যাত্রাটি অর্থহীন প্রতিপন্ন হওয়ার পরে আমি দৃশ্যগুলি নিয়ে কাজ করা শুরু করেছিলাম। দৃশ্য চর্চা করা আর মানুষদের কাছে ব্যাখ্যা করাই আমার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হয়ে উঠেছিল.. আমি শুধু দৃশ্য আবিষ্কারের নেশায় ছুটতে থাকি। মানুষ আমার দৃশ্যের বর্ণনা শুনে দুচার পয়সা যা দিত কোনোরকমে পেটের চিন্তা মিটে যেত। একটা পর্যায়ে গিয়ে আমি মোটামুটি আশাবাদী হয়ে উঠি যে আমার সেরা কিছু দৃশ্য-কর্ম একত্র করে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দিতে পারলে সেগুলি হয়ত বিশেষজ্ঞদের নাড়িয়ে দিবে। এবং সেখানে দৃশ্য গবেষণার জন্য আমি একটি স্থায়ী পদ পেয়ে যেতে পারি। দৃশ্য চর্চাই প্রধানতম লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। এরই মাঝে ফান্দাস আসে, এই ফুলটির ঘ্রাণেগন্ধে আমার অস্তিত্ব নিষিক্ত হয়, ফুলটি মস্তিষ্কের সমস্ত তার জুড়ে পরাগায়িত হয়। ইট ভাঙার কাজে নামার পরে কাজটিতে স্থির হয়ে দৃশ্য-প্রকল্পে পুনরায় ব্যাক করার প্রবল ইচ্ছা থাকলেও উল্টা আমার দৃশ্যগুলিই দিনদিন হারাতে থাকে। দৃষ্টি থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী হয়ে ওঠে.. দৃশ্যগুলি গাঙচিলের সবচেয়ে দূরবর্তী লক্ষ্য হয়ে ওঠে..

মাথার ভিতরে গাঙচিল আর একঝাঁক পাখি ঝাপ্টাতে থাকে। গাঙচিলের দৃশ্য ও আগের সংগ্রহিত দৃশ্যগুলি একসাথে ভেসে ওঠে এবং একটা আরেকটায় ঢুকে অদল-বদল হয়ে যায়। মস্তিষ্কের ভিতর পাক খেয়ে আসে, মাথা ছিঁড়ে যেতে চায়। ‘দৃশ্যগুলি গাঙচিলের দূরবর্তী লক্ষ্য হয়ে ওঠে’ বলে চিৎকার করে উঠি। আমি প্রবল কাঁপতে লাগি। আর বাক্যটি আওড়াতে থাকি। চিকন চিকন তরুণগুলি আমাকে পানশালা থেকে ধাক্কিয়ে বের করে দেয়, এই পাগল-ছাগল কইত্তে আইছে !? আমার পিছনে যুবকটিও বের হয়ে যায়।

হাঁটি। পা টলমল করে। ক্লান্তিতে শরীর ঝুলে পড়ে। কাঁপতে কাঁপতে পড়ে যাই। ঝুপ করে চোখে অন্ধকার নামে, শরীর নিথর হয়ে যায়। যুবকটি ছুটে এসে আমার মাথা ধরে জোরে ঝাঁকি দেয়, কি হইল তোমার, এই! আমি আরো অচেতন হই। বিড়বিড় করে বলি, গাঙচিল দূরবর্তী লক্ষ্যে হামলা করে.. ফান্দাস দূরবর্তী লক্ষ্যে হামলা করে..। যুবকটি বলে, কী বলো উল্টাপাল্টা? ফান্দাস তোমার কে? আমি বলি, দূরবর্তী লক্ষ্য ফান্দাসে হামলা করে..। সে বলে, ধূরো। সে কোথায় থাকে? আমি উত্তর দিতে পারি না। সে বলে, সে কী করে? আমি বলি, সে পড়ায়..

হুঁশ ফিরে দেখি আমি বিশাল এক স্যাতঁসেঁতে ঘরে শুয়ে আছি। ছাদ নাই। চোখ বন্ধ করে গাঙচিলের দৃশ্যটি সাজাই। আমার শরীর বেয়ে শীতল একটি দেহ ধীরে ধীরে ওঠে। মাংস ঠাসা দুটি বাহু কোমর চেপে ধরে। তালের মতো দুটি স্তন আমার হাঁটু উরু পেট ছুয়ে বুকে এসে স্থির হয়। আমার চামড়ায় প্রজাপতির তন্তুর মতো মখমলতা ছড়িয়ে যায়। ত্বকে আগুন ধরার সাথে সাথে মাথা উষ্ণ হয়ে ওঠে। গাঙচিল ঘিরে ছোট পাখিগুলি ওড়ে। গাঙচিল দূরের লক্ষ্যটি শিকারে ব্যর্থ হয়। নিকটবর্তী পাখিগুলিও উড়ে যায়। সে ধৈর্য ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে উড়তেই থাকে। কিছুক্ষণ পরে আরো একঝাঁক পাখি জড় হয়ে তার নিচ দিয়ে বৃত্তাকারে ওড়ে। তার টার্গেটের সারিতে আরো কিছু নতুন পাখি এসে ঢুকে পড়ে। আগের টার্গেটগুলি আরো দূরে সরে যায়। নতুন যোগ দেওয়া পাখিগুলিকে হামলার চিন্তায় কিছুক্ষণ ওড়ে। এরই মাঝে সেখানে আরো কিছু পাখি এসে যোগ দেয়। আগের টার্গেটগুলা আরো দূরে সরে যায়। সে লক্ষ্যের দিকে যত আগাতে থাকে সেটা তত অনিশ্চিত হয়ে ওঠে, অথচ লক্ষ্য ধরার প্রতি তার নিজের নিশ্চয়তা তত বাড়তে থাকে। দূরের লক্ষ্যগুলার তুলনায় কাছের লক্ষ্যগুলা তুলনামূলক বেশি সম্ভব মনে হতে পারে, কিন্তু তার লক্ষ্যকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটাই অর্থহীন। সে সবচাইতে অনিশ্চিত বিষয়টিকে নিশ্চিত মনে করে ঝাঁপিড়ে পড়ছে, এই ব্যাপারটিই দায়ী তার কাছের লক্ষ্যগুলি আরো অসম্ভব হয়ে ওঠার পিছনে। সে তাকে ঘিরে রাখা সার্বক্ষণিক সবচেয়ে নিশ্চিত বস্তুটির ব্যাপারেই গাফেল, সেটা মৃত্যু। এটার প্রতি চূড়ান্ত গাফলতিই তাকে অসম্ভব লক্ষ্যগুলার প্রতি কনফিডেন্স বাড়াতে সাহায্য করে চলে। আমার কোমরের উপর প্রজাপতির তন্তুর মতো মখমল দেহটি তড়পাতে থাকে। চোখ বন্ধ করেই বলি, আহ আমারে কি মাইরা ফেলবা? সে বলে, কথা বলো না। শান্ত হও, ঠাণ্ডা হও। অস্তিত্বরে চূড়ান্ত উদযাপন কইরা মইরা যাও। নতুন অস্তিত্ব গ্রহণ করো।

পুরা ব্যাপারটার খোলাসা আলাপ কী দাঁড়ালো তাহলে? আমি ধরো ওই উড়ন্ত গাঙচিলটাই। আমার জ্ঞান অর্জনের দীর্ঘ যাত্রার লক্ষ্য এটাই ছিল যে আমার এলেম ও চিন্তাফিকির মানুষ জানতে আসবে। তারা আমার কাছে এগুলো শিখতে আসার কোনোই সম্ভাবনা নাই উপলব্ধি হওয়ার সাথে সাথে এই লক্ষ্যের মাঝে ঢুকে পড়ে দৃশ্যগুলি নিয়ে কাজ করার লক্ষ্য। আগের লক্ষ্যটি দূরে সরতে থাকে, দৃষ্টিসীমানার বাইরে চলে যায়, দৃশ্য-প্রকল্প হয়ে ওঠে আমার নিশ্চিত লক্ষ্য। আর আমার নিকটবর্তী লক্ষ্য হিশাবে টিকে থাকে নিজের এলেম থেকে নিজে উপকৃত হতে পারার আশাটুকু। দৃশ্য-প্রকল্প আর নিজের এলেমে নিজে উপকৃত হওয়া, দুইটি লক্ষ্য আমার থেকে দূরবর্তী ও নিকটবর্তী ব্যবধানে উড়তে থাকে। আমি নিশ্চিত ছিলাম না যে আসলেই নিজের এলেম থেকে নিজে ফায়দা নিতে পারতাম কিনা, তবে মনে মনে অনুভব হত যে ফায়দা হয়ত হয়। দৃশ্য গবেষণায় আমার অর্জিত এলেমগুলি হয়ত কিছুটা কাজে আসে।
এরপরে দৃশ্য-প্রকল্পের স্থানে ঢুকে পড়ে ছোট্ট ঘর বানানো কেন্দ্র করে ইট ভাঙার কাজটি। দৃশ্যগুলি দৃষ্টিসীমা থেকে দূরে সরে হারিয়ে যায়, প্রধান ও নিশ্চিত লক্ষ্য হয়ে ওঠে ইট ভাঙা। দৃশ্যগুলি হারিয়ে যাওয়া এবং এগুলি নিয়ে কাজ করতে ব্যর্থ হওয়ার পরে নিজের এলেম থেকে নিজে উপকৃত হওয়ার কোনোই মানে থাকে না। এই লক্ষ্যটিও উড়ে চলে যায়। দিন যাবে দিন আসবে। ইট ভাঙার স্থানে নতুন কোনো পাখি ঢুকে পড়বে। ইট ভাঙা দৃষ্টিসীমার বাইরে উড়ে চলে যাবে। নতুন লক্ষ্যটি কিছুদিন টার্গেট হিশাবে উড়বে। এভাবেই লক্ষ্যের সিলসিলা চলতে থাকবে।

এই প্রক্রিয়াটা ঘটতে পেরেছে কিছু অসম্ভব বস্তু অর্জনের প্রতি আমার সীমাহীন নিশ্চয়তা নিয়ে আগাতে থাকার কারণে এবং চূড়ান্ত নিশ্চিত মৃত্যুর ব্যাপারে গাফেল থাকার কারণে। মৃত্যুর তুলনায় আমার সমস্ত দূরবর্তী ও নিকটবর্তী লক্ষ্যগুলা চূড়ান্ত অসম্ভব। মৃত্যু যেকোনো সময়ই ঘটা অবশ্যম্ভাবী। এটার নিশ্চয়তার তুলনায় কোনো কাল বা বস্তুই তুলনীয় নয়। এজন্যেই দেখা যায় যে একজন মুত্তাকি মুমিন লোক, যার সলাতে, ইবাদতে, প্রতিটা ধাপ ফেলায় মৃত্যচিন্তা সবসময় সজীব থাকে, যাকে দেখলে মনে হয় মৃত্যুকে কবুল করতে উদগ্রীব হয়ে আছে যেন এটাই তার নিশ্চিত লক্ষ্য তার জগতটাই জীবনীশক্তি দিয়ে উপচানো থাকে। এরা লক্ষ্যগুলার দিকে হেঁটে যায় এমন ভঙ্গিমায় যেন লক্ষ্য অর্জন হলে ভালো, না হলে আরো ভালো আলহামদুলিল্লাহ। এরাই এই সভ্যতার সেরা মানব। এরা যদি যুদ্ধের কলাকৌশল নাও জানে, যুদ্ধক্ষেত্রে শুধুমাত্র এদেরকে দাড় করিয়ে রাখবা, দেখবা তাদের সামনে থাকা শত্রুগুলি ঠুসঠাস পড়ে যাচ্ছে।

চোখ খুলে দেখি পাশে ফান্দাসের ঘর্মাক্ত মখমল দেহটি শুয়ে আছে। আমি বলি, আমি এখানে কেন? সে বলে, তুমি এখানেই। এখানে থাকাই নিয়ম। যুবকটি দিয়ে যাওয়ার সময় তাই বলে গেল যে অচেতন অবস্থায় তুমি এই ঠিকানাটাই বলতে সক্ষম হয়েছো। আমি বলি, ওহ সে কোথায় থাকে বিষয়ক কিছু বলে গেছে? সে বলে, নাহ।

যুবকটির জন্য খুব দরদ কাজ করছে। আর আমি তাকে পুরাপুরি চিনতে পারছিলাম না ভেবে নিজেকে হীনও লাগছে। আমি বেশ কয়েকদিন ধরে রাস্তাঘাটে আর পানশালায় তাকে খুঁজি। পাই না। দিনদিন তাকে খুঁজে পাওয়ার তাড়না আমার তীব্র হচ্ছে শুধু।

শেয়ার করুন

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments