চিরায়ত

কমলপুরে কুরবানি


আমার মাদরাসা-জীবনের শুরু কমলপুরে। ধারাবাহিকভাবে পড়েছি নূরানী থেকে জালালাইন পর্যন্ত। চতুর্থ শ্রেণি তক ছিলাম ‘ছোটদের’ তালিকায় —তাই মাদরাসার কোনো কাজের দায়িত্ব ছিল না। পঞ্চম শ্রেণি থেকে নাম ওঠে ‘বড়দের’ তালিকায়। তখন থেকেই সব কাজে উস্তাদরা আমাকে খুঁজতেন। অনুপস্থিত থাকলে জবাবদিহিতা।
কমলপুরে বড় হওয়ায় আমার জন্য সবচেয়ে কঠিন বিষয় ছিল মা–বাবা, ভাইবোন ও পরিবার ছেড়ে মাদরাসায় কুরবানির ঈদ করা। বড়রা কেউ বাড়ি যেত না, ছুটির জন্য আবেদনও করত না। ঈদ মাদরাসায় করার প্রতি তাদের ছিল প্রবল আগ্রহ। শুরুতে বিষয়টি আমার কাছে অবাক লাগলেও পরে আমিও টানা সাত বছর মাদরাসায় কুরবানির ঈদ করেছি।

ঈদের দিন গোরাবা ফান্ডের জন্য চামড়া কালেকশন করা হতো। মাহওয়ারী পরীক্ষা শেষ হতো ঈদের তিনদিন আগে। এই তিনদিন মাদরাসায় থাকলেও ছিল ঘুরাফেরার অবাধ স্বাধীনতা। মনে পড়ে—দল বেঁধে আসমত কলেজ মাঠে ফুটবল খেলতে যাওয়া, কালিপুর ব্রিজ থেকে লাফিয়ে গোসল করা, ফেরিঘাট গরুর বাজারে মহিষ দেখতে যাওয়া, শহীদ হাবিলদার সেতু পার হয়ে হেঁটে ভৈরব থেকে আশুগঞ্জ যাওয়া।
প্রতিদিন সন্ধ্যায় হতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান—তেলাওয়াত, গজল, বক্তৃতা, কুইজ, নাটক ও কৌতুক। অনুষ্ঠান চলত প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত।
একবার কুইজে আমার চিরকুটের সংখ্যা মিলে গেল। বারবার ঘোষণা হচ্ছিল—“৭২ নম্বর কার?” প্রশ্ন এত সহজ ছিল যে দাঁড়ালেই পুরস্কার পাওয়া যেত। কিন্তু এত মানুষের সামনে দাঁড়াতে লজ্জা লাগছিল। সবাই তাকিয়ে থাকবে—এই ভয়ে উঠিনি। কমলপুর ছেড়ে আজও সবচেয়ে বেশি মিস করি কুরবানির আগের এই তিনটি দিন।


ঈদের সপ্তাহখানেক আগে একটা মজলিস হতো। ছাত্র-উস্তাদ সবাই মসজিদে বসত এশার পর । ফরিক ভাগ করা হতো কুরবানির কাজের জন্য। কে কোন এলাকায় যাবে, কোন উস্তাদের নেতৃত্বে থাকবে, মাদরাসায় কারা অবস্থান করবে—সব পরিকল্পনা হতো তখনই।
ছাত্ররা পরিচিত আর পছন্দের উস্তাদের ফরিকে যাওয়ার জন্য তোরজোড় করত।
আমার নাম আসে আব্দুর রহীম সাহেব হুজুরের ফরিকে। দায়িত্ব: পাকিস্তান বাড়ি থেকে আমলাপাড়া এলাকা। এই নাম শুনেই সবাই হেসে উঠল। উস্তাদরা মজা করে বলতেন—বাংলাদেশে থেকেও তোমার দায়িত্ব পাকিস্তান বাড়ি!


ঈদের কয়েকদিন আগে বারি বাড়ি গিয়ে আমরা কুরবানির চিঠি বিলি করতাম। কমলপুর মাদরাসা থেকে এসেছি শুনেই মানুষ আন্তরিকতা দেখাত, কেউ কেউ আপ্যায়ন করত। কোনো বাড়ির গেট বন্ধ থাকলে কাগজের চিঠি দিয়ে প্লেন বানিয়ে বাড়ির ভেতর উড়িয়ে দিতাম। হুজুররা জানলে অবশ্য রক্ষা ছিল না।
এই দিনটির জন্য মাদরাসা অফিস থেকে বাজেট থাকত। প্রতি ছাত্র ২০ টাকা করে। ফিরে এসে মাছবাজার থেকে সিঙ্গারা আর আখতার মিয়ার দোকান থেকে আইসক্রিম খেতাম। এই দিন ক্লাস হতো না। যোহরের পর লম্বা ঘুম, সবক না শিখেও পরদিন বেঁচে যাওয়া।


ঈদের আগের দিন প্রত্যেক ফরিকে চার-পাঁচটি করে ছুরি দেওয়া হতো। আগে গেলে ভালো মানের রেতের ছুরি পাওয়া যেত। রাতে আমরা বাঁশে শুকনা বালি রেখে ছুরি শান দিতাম। যারা হাদিয়া পেত, তারা অবশ্য দোকানে গিয়ে ছুরি শান দিত।
একসময় ভাবতাম—হুজুর হলে তো গরু জবাই করতে হয়, আমি পারব কীভাবে? কাফিয়ার বছর হুজুর আমাকে জোর করে ছুরি দিলেন। বললেন—আমি পাশে থাকব, ভয় নেই। এবার তুমি জবাই করো। ঈদের দিন বুক ধড়ফড় করছিল, হাত কাঁপছিল। পিছনে হুজুর দাঁড়িয়ে আছে। এত মানুষের সামনে না করতে পারিনি। সাহস করে ছুরি চালালাম। আমার পুরো জামা রক্তে ভিজে গেল। মনে সাহস এল। মনে হল, এ–তো সহজ কাজ, ভয় কিসের? এরপর ছুটে গেলাম আরেক গলিতে। ঐ ঈদে পাঁচটি গরু জবাই করলাম। হাদিয়া পেলাম ৭০০ টাকা। হুজুরের জন্য তখন অন্তর থেকে দুআ করেছি। তিনি না থাকলে হয়তো এখনো ‘হুজুর’ হতে পারতাম না।


ঈদের দিন ফজরের পর সবাই হাউজে গোসল করে। পিছলে পড়ার নাম করে ইচ্ছা করে লাফিয়ে পড়ে হাউজে, পানি ছিটায়। পুরো হাউজজুড়ে আনন্দ–উল্লাস।
গোসল শেষে সবাই সাজগুজ করে। আমি আম্মাকে ফোন দিই—আব্বা কী করছে, ভাইয়ারা ঘুম থেকে উঠেছে কিনা, গরুকে গোসল করাবে কখন— অভিবাবকের মতো সব খোঁজ নিই।
সকাল ছয়টায় বোর্ডিংয়ে নাস্তা। নাস্তা না বলে এটাকে ‘খাবার’ বলা ভালো। কফিল উদ্দিনের রান্না করা লাল পায়েস দিয়ে শুরু, এরপর মুরগির মাংস দিয়ে ভাত। ঈদের দিন বোর্ডিংয়ে খাওয়ায় বাধা-সীমা থাকত না—যার যত খুশি খাওয়া যেত।
নতুন জামা পরে মাঠে গিয়ে ঈদের নামাজ পড়া। খুতবার পর জামা বদলে ছুরি হাতে ছুটে চলা। এলাকায় গিয়ে প্রথমে গরু জবাই করা। তারপর মসজিদের বারান্দায় দীর্ঘ সময় অপেক্ষা। দুপুর বারোটার দিকে চামড়া সংগ্রহ করে রাস্তার পাশে জমা করা। কেউ পুরো চামড়া দান করত, কেউ অর্ধেক দিত—বাকি অর্ধেকের টাকা হিসাব করে ফিরিয়ে দেওয়া। সবকিছু যেন মোহময় স্মৃতি। দুপুর দুইটায় বড় ট্রাক এসে চামড়া নিয়ে যেত। এরপর ফিরতাম মাদরাসায়। গোসল করে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার—সারি সারি ডেকচিতে সাদা ভাত, পোলাও, গরুর মাংস। যার যত খুশি গ্রহণ।
ঈদের পরদিন থেকে ছুটি শুরু হলেও আমার বাড়ি মাদরাসা থেকে মাত্র সাত কিলোমিটার দূরে হওয়ায় ঈদের দিন বিকেলেই চলে যেতাম।
পরদিন মাদরাসার মাঠজুড়ে ছড়িয়ে থাকত লবণ মাখানো চামড়া। ১৫–২০ দিন রোদে শুকিয়ে সেগুলো বিক্রি করা হতো। আজও মনে পড়ে—পঁচা চামড়ার গন্ধে নাক চেপে ধরে মাঠের পূর্ব পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি।

চৌধুরীপাড়া, ঢাকা-১২১৯

শেয়ার করুন