বায়তুল মোকাররম চত্বরে তখন সোনাঝরা রোদের পশরা সাজিয়ে বসেছে শহুরে বিকেল। চারদিকে ঝলমলে আলোর বহুরৈখিক বিচ্ছুরণ। এর ভেতর দিয়ে আমরা তিন তরুণ-পরাগ উপস্থিত হলাম চিরায়ত’র মোড়ক উন্মোচন মুখাড্ডায়। আমি আর আবদুল আহাদ কাউসার এসেছি কিশোরগঞ্জ থেকে। ভোরের ট্রেনে এগারোসিন্দুর প্রভাতি-তে রওনা হয়েছি। জুমা পড়েছি ফরিদাবাদ মাদরাসায়, বন্ধুবরেষু মাসরুর জাকারিয়া’র আমন্ত্রণে। সেখানে ভ্রাতৃবরেষু নেসারুদ্দীন রুম্মান-এর সঙ্গে সাক্ষাত। তাদের সাক্ষাত ও আতিথ্য আমাদের বিপুল বিমোহিত করেছে। মাসরুরকে সঙ্গে নিয়ে সেখান থেকে রওনা হলাম। নগরজীবনের ব্যতিব্যস্ত সমুদ্রে সময়তরঙ্গের তাড়া খেয়ে পৌঁছলাম মুখাড্ডাপীঠে। দক্ষিণ গেইটে আমাদের স্বাগত জানালেন সম্পাদক খুবাইব মাহমুদ। সৌম্যকান্ত তরুণ। মুগ্ধতার দীপ্তি মুখাবয়বে যেমন—বোধ হলো মননেও তেমন। আজই আমাদের প্রথম দেখা। মূলত তার আমন্ত্রণে এখানে আসা।
আধা পাড়াগেঁয়ে আর আধা মফস্বলে এই আমি; গঙ্গাবুড়ির শহরে কোনো উপলক্ষ্য ছাড়া তেমন আসা হয় না। যে কয়েকবার এসেছি, বেশির ভাগ কর্তব্যের খাতিরে। তবে আজকের আসার পেছনে রয়েছে এক নান্দনিক উপলক্ষ্য। ছোটোকাগজ চিরায়ত, এই কাগুজে ফুলের পাপড়িদলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব আন্তরিক। যখন থেকে তারা ভাঁজপত্র পরশ নামে প্রকাশ করছে, তখন থেকে। অভিব্যক্তি করে বলতে হয় পরশের আন্তরিকতা হয়ে গেছে চিরায়ত। আবদুল আহাদ কাউসার—আমার বন্ধু ও সহপাঠী সে-ও এই দলের পাপড়ি। তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্কের পরাগ ভোমরা সে। তার আমন্ত্রণে এই কাগজে প্রথম লিখেছি। খুবাইব মাহমুদ আমার লিখিয়ে বন্ধু এই দলের কেশর। এবং অন্যরা। প্রথম দেখায় সবাই আমার প্রতি দারুণ আন্তরিকতা দেখালেন।
মুখাড্ডার আসরে আমাদের উপস্থিত হতে খানিকটা দেরি হয়ে গেল। দেখি, আসর শুরু হয়ে গেছে। মধ্যমণি হয়ে বসে আছেন শ্রদ্ধাভাজনেষু সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর আর এহসান সিরাজ। তাদের সামনে একদল উচ্ছ্বসিত প্রাণ তরুণ-পরাগ। কেউ চেনামুখ, কেউ হেনামুখ। বন্ধু নূর মুহাম্মদ সাইফুল্লাহকে বেশ উজ্জ্বল দেখাল। বলতে হবে, এটা তার বাবরি দোলানো চুলের কারণেই। আমাদের দেরি করে আসতে দেখে সাজা ভাই কপট রাগ দেখিয়ে কী যেন বলে বসলেন। ধরে নিলাম, এটা তার ভালোবাসার চোটপাট। হাসি হাসি মুখ করে তার পাশে গিয়ে বসলাম। স্মিতমুখে করমর্দন হলো। উপস্থিত বন্ধুদের দিকে কুশলকমল দৃষ্টিতে তাকালাম।
সাজা ভাই মুক্তোবাণী ঝাড়ছিলেন মাদরাসাপড়ুয়াদের লেখালেখি নিয়ে। প্রসঙ্গে এলো চিন্তাগত দৈন্যের ব্যাপারটা। মাদরাসাপড়ুয়াদের মধ্যে যারা লেখালেখি এবং বইপত্র প্রকাশ করে, তাদের অধিকাংশের চিন্তা-ভাবনা থাকে এমন : তার এই লেখাটি বা বইটির পাঠকশ্রেণি হবে শুধু ইসলামি অঙ্গনের লোকেরা; হয়তো উলামা-তলাবা বা মহিলা মাদরাসার জেনানাগোষ্ঠী। এটা একপাক্ষিক চিন্তা এবং চিন্তাগত দৈন্যও বটে। আমাদের এই চিন্তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। লেখককে হতে হবে সর্বদলীয় এবং দলমতের ঊর্ধ্বে। লেখালেখির ব্যাপারটাকে পাঠকগত পরিধিতে আটকানো যাবে না। এই আলোচনার সূত্র ধরে চলল জীবন-দর্শন, রাজনীতি, আধ্যাত্মিকতা, ব্যক্তি ও সমাজ পর্যালোচনার রকমফের কথাবার্তা। শেষে আসরের আজানের পরপর হয়ে গেল মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান। পত্রিকার লেখাজোখা, সাজসজ্জা সবাইকে আকর্ষিত করতে পেরেছে বলে মনে হলো। প্রচ্ছদ রচনায় ছাপা হয়েছে আমারও একটি লেখা।
নামাজের পর শুরু হলো মুখাড্ডার দ্বিতীয় দফা। সাজা ভাই তখন একলা। এহসান ভাই জরুরি কাজ দেখিয়ে চলে গেছেন। আবারও শুরু হলো সাজা ভাইয়ের হৃদয়জ আলোচনা। এর আগে নামাজের বিরতিতে চেনামুখ ও হেনামুখ অনেকের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ও পরিচয় হয়ে গেল।
লিখিয়ে বন্ধু তানজিল আরেফিন আদনান, রাশেদ মুহাম্মাদ, সাইফুদ্দীন খালিদ, হাবিব আনোয়ার প্রমুখের সঙ্গে প্রথম দেখা ও পরিচয় হলো। নূর মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ, উমারা হাবিব, আবদুল্লাহ শাকের, আহমাদুল্লাহ ইকরাম, ইনামুল হক প্রমুখ চেনামুখদের সঙ্গে হলো হাসিমুখ কথাবার্তা। দ্বিতীয় দফার মুখাড্ডায় আলোচনার বিষয় ছিল চিন্তাগত প্রসারতার ব্যাপারটা। এটা নিয়ে নূর এবং কয়েকজন সাজা ভাইয়ের সঙ্গে শুরু করল তর্ককথার ভাব বিনিময়।
পুরোটা সময় আমি সব চুপচাপ শুনে গেলাম। সাহিত্যের রসামোদ ছাড়া আর কিছু আমাকে তেমন উদ্দীপ্ত বা আপ্লুত করতে পারে না। মাগরিবের নামাজ পড়তে হলো এখানে। কী এক বিশিষ্ট লোক জানি এদিকে এসেছেন, তার জন্য সাময়িক অবরোধ করা হলো এই এলাকা। নামাজের পর হালকা আপ্যায়ন এবং সংক্ষিপ্ত কথাবার্তা হলো। সন্ধ্যার আগে-পরে হয়ে
গেল ফটোসেশন।
এক ফাঁকে রাশেদ ও আদনান ভাই ঘিরে ধরলেন আমাকে। তাদের সঙ্গে হাসিমুখ কথাবার্তা হলো। সাহিত্য বিষয়ক প্রশ্নোত্তর পর্বটি আমাকে খুব উচ্ছ্বসিত করেছে। মনে হলো, কথা বলায় প্রাণবন্ততা পেয়েছি। একটু পরে জানা গেল অবরোধ উঠে গেছে। সাজা ভাইয়ের সঙ্গে নূর, মাসরুর, আবদুল আহাদ আর আমি মুখাড্ডার ইতি টেনে বেরিয়ে এলাম। শহর জুড়ে তখন থার্টি ফার্স্ট নাইটের অশোভনীয় নাগরিক রাত্রির আয়োজন। জাতীয় মসজিদের গেইটে দাঁড়িয়ে বড়ো ম্রিয়মান মনে হলো মসজিদের নগরী ঢাকাকে।