চিরায়ত

সে আর ফিরে আসেনি

আহরার হতবাক! একদমই হতবাক! এইমাত্র তার পাশেই ছিল হারীর। একমাত্র ছোট ভাই। এখন নেই। মুহূর্তের মধ্যেই কই যেন উধাও হয়ে গেল। আহরারের বুকটা ধক করে উঠল। পাগলের মতো মাথা ঘুরিয়ে পাশেপাশে তাকাল সে। পেটুয়া বাহিনীর তাড়া খেয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো কমলাপুরের দিকে ছুটে চলেছে মুসল্লিদের মিছিল। সেই মিছিলের সঙ্গী হয়েছিল ওরা দুই ভাই। মিছিলের ওপর চোখ ঘুরাল আহরার। নেই। হারির তাদের মধ্যে নেই। অথচ একটু আগেও পাশেই ছিল ছোট ভাইটা। হঠাৎ যেন ঘুরে উঠল আহরারের মাথাটা। চোখের সামনে নেমে এলো অন্ধকারের পর্দা। পড়ে যেতে যেতে কোনো রকমে সামলে নিল নিজেকে। লক্ষ লক্ষ মানুষের স্রোতে কই হারিয়ে গেল হারির?

মিছিল এগিয়ে চলল কমলাপুরের দিকে। শাপলা চত্বর থেকে বেরোনোর শুধু এ পথটাই খোলা। আর সব পথের প্রবেশ মুখে হাজার হাজার পেটুয়া বাহিনী অস্ত্রহাতে দাঁড়িয়ে। মুসুল্লিদের তাড়া করছে নেকড়ের মতো। হামলে পড়ছে যখন তখন। শুধু কমলাপুরে যাওয়ার পথটাই উন্মুক্ত। প্রাণ বাঁচাতে মুসুল্লিরা স্রোতের মতো ভেসে যাচ্ছে সেদিকেই।

মাদরাসার ছাত্র এবং সাধারণ মুসুল্লিদের সাথে আহরার এবং হারির সকালেই যোগ দিয়েছিল শাপলা চত্বরের সমাবেশে। সারাদিন বয়ান এবং দুআ শেষে আছরের পর সমাবেশ শেষ করে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুপুর থেকেই পেটুয়া বাহিনী এমনভাবে ঘিরে রেখেছিল সবাইকে, বের হওয়ার কোনো সুযোগই পাওয়া যায়নি। বিকেল গড়িয়ে রাত বাড়ার সাথে সাথে নানা আশঙ্কা, আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠা বেড়েছে।

এরপর রাত বারটার দিকে হামলে পড়েছে পেটুয়া বাহিনী। মেরে রক্তাক্ত করে মুসুল্লিদের হাঁকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পশুর মতো। জীবন বাঁচাতে মুসুল্লিদের সাথে দৌঁড়োতে শুরু করেছিল আহরার আর হারির। দুই ভাই পাশাপাশিই ছিল সারাক্ষণ। কমলাপুরের কাছাকাছি আসতেই হারির কই হারিয়ে গেল। সেই থেকে নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না আহরার। বুক ফেটে কান্না আসছে। ওকে রেখে একা একা বাসায় গেলে বাবা-মার কী অবস্থা হবে, ভেবেই দুমরে মুচড়ে যাচ্ছে বুকটা।

আহরার বয়সে বড়। ওর আঠারো চলছে। হারিরের পনের। পিঠাপিঠি বড়ো হয়েছে। শত শত স্মৃতি ওর সাথে! কত আদর করে ছোট ভাইটাকে! কই হারিয়ে গেল সেই ভাইটা? মরিয়া হয়ে খুঁজতে শুরু করল আহরার। সামনে-পেছনে, ডানে-বাঁয়ে যতদূর চোখ যায় খুঁজে দেখল। নেই! ছোট ভাইটা নেই! কোথাও নেই!

ওদের মাদরাসার সব ছাত্রই এসেছে। পেটুয়া বাহিনীর দৌড় খেয়ে সবাই ছিটকে গেছে কোথাও। কাউকেই দেখা যাচ্ছে না আশেপাশে। ওরা থাকলেও বেশ কাজ হতো। সবাই মিলে খুঁজে দেখা যেতো।

হাঁটতে হাঁটতে কমলাপুর। কমলাপুর থেকে যার যার গন্তব্যের পথ ধরল মুসুল্লিরা। আহরারের চোখেমুখে দুশ্চিন্তা। হারিরকে খুঁজতে খুঁজতে তখন ভোর। শেষ মুসল্লিটি বিদায় হওয়ার পরও অসহায় দাঁড়িয়ে রইল আহরার। মনটা বিষণ্ন। চোখে অশ্রু, ক্লান্ত হয়ে এসেছে দেহ। দু’পা নিশ্চল। নড়তে পারছে না।

হঠাৎ পেটুয়া বাহিনীর এক সদস্য এগিয়ে এলো ওর দিকে। ‘কি চাই এখানে?’ চেঁচিয়ে উঠল লোকটা। অস্ত্রের বাঁট নামিয়ে আনার ভঙি করল ওর মাথা লক্ষ করে। সাঁৎ করে পেছনে সরে গেল আহরার। পীরজঙ্গী মোড়ের দিকে হাঁটা ধরল দ্রুত। পীরজঙ্গী মোড় পেরিয়ে রাজারবাগ, রাজারবাগ থেকে ডান দিকে মোড় নিয়ে সোজা খিলগাঁও রেলগেইট। ওখানে ট্যাক্সি পেয়ে গেল। উঠে বসল সামনের সিটে।

ওকে দেখেই হইচই করে ছুটে এলো কয়েকটা ছেলে। মুখে বিঁদঘুটে দুর্গন্ধ। চোখ ঘোলাটে। ড্রাগ এডিক্ট। কিছুক্ষণ আগেই হয়তো ড্রাগ নিয়েছে। ঝটকা মেরে ট্যাক্সির সামনের দরজা খুলে ফেলল ছেলেগুলো। ‘হেফাজতিটাকে নামা’ বলতে বলতে চেপে ধরল আহরারের কলার।

‘এই তুই কইত্থেইকা আইছোস? একজন টান মারল আহরারের কান ধরে।’

আহরার চুপ করে থাকল। কী বলবে বুঝতে পারছে না।

‘কথা ক মাদার…..’ খেঁকিয়ে উঠল আরেকজন।

উসখুস করে উঠল আহরার। কী করবে বুঝতে পারছে না। ছেলেগুলো ক্ষেপে উঠছে। কথা না বললে আরো ক্ষেপে উঠবে। কথা বললেও রেহাই নেই। সত্যটা জানলে মার একটাও মাটিতে পরবে না। ‘আমার ভাইটা হারায়া গেছে, ওরে খুঁজতে গেছিলাম।’ কোনো রকম বলল আহরার।

‘দেহি, তোর পা দেহা তো?’ নেতা গোছের একজন গুতা মারল আহরারের পেটে।

পা বের করে দেখাল আহরার। ঝুঁকে ওর জুতোজোড়া দেখল ছেলেগুলো। ‘পায়ে দেহি জুতা আছে। ছিড়েও নাই। যেই দৌড় খাইছে, হেফাজতি অইলে পায়ে জুতা থাকতো না।’ আহরারের মাথায় একটা ধাক্কা মেরে সরে গেল ছেলেগুলো।

ট্যাক্সি ছেড়ে দিতেই আটকে আসা দম ছাড়ল আহরার। বড় বাঁচা বেঁচে গেছে আজ। আবার হারিরের কথা মনে পড়ে গেল। মনটা আবার গেল খারাপ হয়ে!

(পূর্বপ্রকাশ : চিরায়ত শাপলানামা সংখ্যা)
শেয়ার করুন