চিরায়ত

শ্রীমঙ্গলে বন্ধুর বিয়েতে

রাত তিনটা পঞ্চান্ন, শ্রীমঙ্গল স্টেশন। 

ট্রেন থেকে নেমেই মাহফুজের সাথে দেখা। পেছনে সুমামা আর ওর এলাকার দুজন বন্ধু। আবিদ আর এমাদ। আগেই ওদেরকে বগি নাম্বার বলা ছিলো। তাই ট্রেন থেকে নেমে ওদেরকে খুঁজে বের করতে হলো না। ওরা আগে থেকেই আমাদের বগির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো।

সবার সাথে কুশল বিনিময়ের পর আমরা স্টেশন থেকে বের হলাম। মজার ব্যাপার হলো, স্বয়ং জামাই নিজে আমাদেরকে নিতে এসেছে। বিষয়টা ভালো লাগলো। সুমামা আমার ক্লোজ বন্ধুদের একজন। সর্বোপরি সে আমাদের ব্যাচেলর হাবের একজন সদস্যও। একসাথে একরুমে ছিলাম। খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরা, উঠাবসা—সবই একসাথে। আমাদের পাঁচজনের এই গ্রুপটার নাম ছিলো ব্যাচেলর হাব। 

স্টেশনের পাশেই একটা হোটেলে ঢুকে হাতমুখ ধুয়ে নিলাম। এতে একটু ফ্রেশ লাগছিল। আজকের ট্রেনজার্নিটা বেশ কষ্টকর ছিলো। একে তো নন-এসি বগি, তারউপর আবার ভাঙাচোরা ট্রেন। খুব কষ্ট করে এসেছি শ্রীমঙ্গল পর্যন্ত। 

***

খাওয়া-দাওয়ার পাঠ চুকিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য সুমামার বাসা। সারারাতের জার্নিতে সবাই মোটামুটি ক্লান্ত। একটু বিশ্রাম না নিলেই নয়। 

আমরা সোজা গিয়ে উঠলাম আবিদের বাসায়। এখানেই আমাদের থাকার বন্দোবস্ত হয়েছে। আমরা সবাই ব্যাগপত্র রেখে একে একে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। তারপর একটা ছোট্ট বৈঠকের পর আমরা সবাই এই মর্মে সম্মত হলাম—এখন আর বিশ্রামের দরকার নেই। তারচে’ বরং সুন্দর এই সকালটা কাটাবো শ্রীমঙ্গলের বিখ্যাত চা-বাগানের মনোরম পরিবেশে। আমরা কাপড় পাল্টে ঝটপট বেরিয়ে পড়লাম। 

***

সকালটা বড্ড সুন্দর। সুমামাকে রেখেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম সুন্দর এই সকালটা উপভোগ করতে। আজ বেচারার বিয়ে। অথচ গতরাতে এক ফোটা ঘুমোয়নি। ওকে তো একটু ঘুমোতে দেওয়া উচিত। 

আমাদের সঙ্গে অবশ্য এমাদ আর আবিদ আছে পথপ্রদর্শক হিসেবে। আমাদের আপাতগন্তব্য শ্রীমঙ্গলের বিখ্যাত পাঁচতারকা হোটেল গ্র্যান্ড সুলতান। ওদিকের চা-বাগানগুলো বেশ নিরিবিলি। আমি অবশ্য এর আগেও দু’বার এসেছি শ্রীমঙ্গলে। তাই এসব জায়গা আমার কাছে নতুন কিছু নয়। তবুও বের হলাম প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে দারুণ একটা সময় কাটাতে। 

একটা টঙের দোকানে বসে আমরা আড্ডা জমালাম। পাশেই চা-বাগান। আনাস আর আবু বকর ছবি তোলায় ব্যস্ত। অবশ্য ওরা দুজনেই বেশ দারুণ ছবি তোলে। ছবি তোলাটা যে ওদের শখ এবং নেশা—সেটা ওদের তোলা ছবিই প্রমাণ করে। 

আমি শুরুতে বেশ কিছুটা সময় ওদের সাথে থেকে ছবিটবি তুললাম। তারপর এসে যুক্ত হলাম আড্ডায়। এতক্ষণে অবশ্য আড্ডা জমে ক্ষীর। রাজনীতি নিয়ে আলাপ চলছে। সবাই যার যার মতামত ব্যক্ত করছে। একেবারে চায়ের কাপে ঝড় উঠাচ্ছে যেন একেকজন। 

এদিকে আমি যেন এক নির্বাক শ্রোতা। চুপচাপ বসে শুনছি কেবল। ব্যাপারটা বেশ উপভোগ্যই বটে। মাহফুজও আমার মতোই বসে আছে চুপচাপ। যদিও সে ফোনের স্ক্রিনে মগ্ন। আমি আবার ওসব পারি না। আড্ডায় বসে ফোন চালানোটা বিরক্তিকর। চেষ্টা করি এই অভ্যেস থেকে নিজেকে বিরত রাখতে। 

***

সকালের নাস্তাটা সেরে নিলাম পানসীতে। মুরগি ভুনা দিয়ে গরম খিচুড়ি। খাবারটা বেশ সুস্বাদু ছিল। পানশীর খাবার এমনিতেই আমার ভালো লাগে। যখনই শ্রীমঙ্গলে আসি, পানসীতে এসে খেয়ে যাই।

খাওয়াদাওয়ার পাঠ চুকিয়ে বাসায় চলে এলাম সবাই। ঘড়ির ছোট্ট কাঁটাটা দশ ছুঁইছুই। তাড়াতাড়ি গোসল করে তৈরি হতে হবে। বারোটার দিকে সুমামার গাড়িবহর রওনা দিবে। তার আগে আরও কিছু আনুষ্ঠানিকতা তো আছেই। সেগুলোও তো সাড়তে হবে। 

আমরা ঝটপট তৈরি হয়ে নিলাম। মানুষ বেশি বলে একটু সময় লেগে গেল। ততক্ষণে সুমামা এসে হাজির। এসেই আমাদেরকে তাড়া দিতে লাগলো। আমরা সাজগোজের অন্তিম ধাপ সমাপ্ত করে ওর সাথে বেরিয়ে পড়লাম। 

***

শুরুতেই আমরা গেলাম মুসাফির নিবাসে। বরযাত্রা শুরুর আগের যত আনুষ্ঠানিকতা—সব এখানেই হবে। সুমামার মামা-খালু সবাই উপস্থিত। একটু পরে ওর আব্বু এলেই শুরু হলো ‘বর সাজানো’র আনুষ্ঠানিকতা।

শুরুতেই আঙ্কেল সুমামার গায়ে জুব্বা চাপিয়ে দিলেন। তার উপর সুন্দর নকশাদার কটি। মাথায় পরিয়ে দিলেন পাগড়ি। সবশেষে পরিয়ে দিলেন আলখেল্লা। ব্যস, বর সাজানোর আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন। এবার অন্দরমহল থেকে এলো বরের জন্য সাজানো ইয়া বড়ো থালা। প্রথমে বরকে সেই থালা থেকে একটু খাইয়ে থালাটা উদ্বোধন করা হলো। তারপর আমরাই (বরের বন্ধুরা) পুরোটা সাবড়ে দিলাম।

***

বরযাত্রার জন্য তিনটা গাড়ি প্রস্তুত করা হয়েছে। জামাইয়ের জন্য একটা প্রাইভেট কার, বাকিদের জন্য দুটো হাইস। আমরা যারা বরের বন্ধু তারা একটা হাইস দখল করবো ভাবলাম। কিন্তু সুমামা এসে আমাকে বললো ওর গাড়িতে গিয়ে বসতে। শেষমেশ তাহলে বরের গাড়িতে করে যেতে হবে? ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং। 

গাড়ির বহর চলতে শুরু করলো। সবার আগে বরের গাড়ি। তারপর দুটো হাইস। একেবারে পেছনে সুমামার আব্বু আরেকটা প্রাইভেট কার নিয়ে আসছেন। আমাদের গন্তব্য বরুনা মাদরাসা। 

বরের গাড়িতে সামনে বসেছে ড্রাইভার আর একজন হুজুর। পেছনে আমি, সুমামা আর তামিম। আমরা গল্প করতে করতেই একটা সময় চলে এলাম বরুনা মাদরাসায়। 

***

বাদ যোহর বিয়ে পড়ানো হলো। বিয়ে পড়ালেন মুফতি রশীদুর রহমান ফারুক বর্ণভী (বরুনা পীর সাহেব) হুজুর। তারপর লম্বা একটা দোয়া হলো। দোয়ার পর প্রথা অনুযায়ী ছিটানো হলো খেজুর। বন্ধুদের মধ্যে কাউকে আবার হাতভরে খেজুর নিয়ে সেগুলো টিস্যু দিয়ে পেচিয়ে পকেটে রাখতে দেখলাম।

মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা বরের সাথে ফটোসেশানটা সেরে ফেললাম। তারপর আবারও যে যার গাড়িতে গিয়ে বসলো। এবারের গন্তব্য মৌলভীবাজার সদর। সেখানকার একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টেই মেহমানদারির বন্দোবস্ত করা হয়েছে। 

***

রেস্টুরেন্টের নাম Monsoon Chinese Restaurant। কনেপক্ষের সবাই আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আমরা যেতেই তারা আমাদেরকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে ভেতরে নিয়ে গেলেন। আমি ফাঁকে ফাঁকে কিছু ভিডিও শট, কিছু ছবি নিয়ে রাখছিলাম। 

আমরা বন্ধুরা একসাথে নয়া দামানের সাথেই খেতে বসলাম। খাবারের মেন্যুটা জম্পেশ ছিল। বিশেষ করে গরুর গোশত আর শেষ পাতে ফিরনি—এই দুটো জিনিসের স্বাদ পরবর্তী কয়েকটা দিন আমার মুখে লেগে ছিল। 

খাওয়ার পর আরেকদফা ফটোসেশান হলো বরের সাথে। তারপর বর এবং তার অভিভাবকেরা রওনা দিলেন কনের বাড়ির উদ্দেশ্যে। আর আমরা সরাসরি শ্রীমঙ্গল চলে এলাম। 

***

সন্ধ্যে নামার পরে আমরা বের হলাম। গন্তব্য বিখ্যাত পানসী হোটেল। আমরা যাওয়ার কিছুক্ষণ পর সুমামা ওর শ্যালক এবং শালাতো ভাগিনাকে নিয়ে হাজির। সবাই মিলে ফালুদা আর আচার খেলাম। পরে বিল দিতে গিয়ে বাঁধলো বিপত্তি। হিসেবের বেশি বিল আসলো কেন জানতে চাইলাম। আমাদেরকে বলা হলো, আপনারা যে রিকশায় এসেছেন সেই রিকশাওয়ালা আপনাদের কথা বলে খেয়ে গেছে। এটা শুনে হাসবো নাকি কাঁদবো বুঝতে পারলাম না। বিল মিটিয়ে আস্তে করে বের হয়ে চলে আসলাম।

রাতে সুমামা আসলো আবিদের বাসায়। বেচারা বউ রেখে এখানে কেন আসলো কে জানে। কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম একসাথে। তারপর ওর হাতে তুলে দিলাম বিয়ের উপহারসামগ্রী। সুমামা বললো, আজকে আর তোমাদের যাওয়ার দরকার নেই। আগামীকাল অলিমা হবে। অলিমা পার করে তারপর যাও। আমরা বেশ দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে গেলাম। শুরুতে পরিকল্পনা ছিল, এখন কেবল বিয়েটা হবে। পরে ধুমধাম করে অলিমা করা হবে। যে কারণে বন্ধুবান্ধব অনেককেই দাওয়াত করেনি সুমামা। এদিকে আজকেই নাকি বাসার মুরব্বিরা বসে সীদ্ধান্ত নিয়েছেন, আগামীকালই অলিমা সেরে ফেলা হবে। 

একটু পরে সুমামা চলে গেল। যাওয়ার সময় বলে গেল বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করতে। সবাইকে যেন দাওয়াতটা পৌঁছে দেই। আমি অনেককেই ফোন দিলাম। কিন্তু এমন হুটহাট করে কি আর চলে আসা যায়? সবারই নানাবিধ ব্যস্ততা ছিল। সবমিলিয়ে দেখা গেল, কেউই আর আসতে পারলো না। 

***

পরেরদিন দুপুরে অলিমাটা পার করে আমরা আবারও ঘুরতে বের হলাম। পুরোটা বিকেল চা-বাগানের মধ্যে আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসলাম। 

রাত দশটার দিকে বেরিয়ে পড়লাম বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে। আমাদেরকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য এলো এমাদ আর আবিদ। এই ছেলেদুটো গত দুইটা দিন আমাদেরকে সময় দিয়েছে। সদ্য পরিচিত কারও সাথে এতোটা মেশা যায় না। তবে ওরা আমাদের সাথে মিশে গেল। এই দুটো দিন আমাদেরকে এমনভাবে আপ্যায়ন করলো—যেন আমরা সুমামার না, ওদেরই মেহমান।

শেয়ার করুন