চিরায়ত

শাপলার এথিকাল ন্যাচার

যদিও আমরা আজকে জানি যে আলেক্সান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি ধ্বংসের দায় মুসলমানদের না, তথাপি আলেক্সান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি ধ্বংস যে মুসলমানরা করেছে এমনটা মুসলমান রেওয়াতেও আছে। রেওয়াতটা এমন, আমর ইবনুল আস (রা) মিশর বিজয়ের পর খলিদা ওমরের (রা.) কাছে চিঠি লিখে জানতে চান বিজিত ভূমিতে প্রাপ্ত লাইব্রেরির ব্যাপারে করণীয় সম্বন্ধে। হযরত ওমর (রা.) বলেন, ‘যদি কেতাবাদি কোরানের সাথে একমত হয় তাহলে সেসব কেতাবের তো আমাদের দরকার নেই (যেহেতু ইতোমধ্যেই আমাদের কাছে কোরআন আছে), আর যদি এসব কেতাবাদি কোরআনের বিরুদ্ধে যায় তাহলে তাদের ধ্বংস করে দাও।’

প্রশ্ন হচ্ছে, কেন মুসলমানরা এই কিসসা বর্ণনা করল? তারা কি এর মধ্যে শরমিন্দা বা জুলুম তালাশ করে পায়নি? সালমান সায়্যিদ এ প্রসঙ্গে বলছেন, সম্ভবত প্রাক-ঔপনিবেশিক জামানার মুসলমানরা কোনো প্রকার অ্যাপোলজি ছাড়াই সাহাবীগন যে কোরআনের এথিকাল ন্যাচারের সমঝদার ছিলেন তা একিন করত। কোরআন এমন কেতাব যা সকল কেতাবাদিতে লিপিবদ্ধ সকল জ্ঞানের চেয়ে বেশি জ্ঞান রাখে। অন্য সকল কেতাব সময় বা স্থানের সাপেক্ষে সীমাবদ্ধ। কিন্তু কোরআন সর্বজনীন। এ কারণেই কোরআন সকল ধরণের ইন্দ্রীয় জ্ঞানের উর্ধ্বে—এটাই কোরআনের এথিকাল ন্যাচার।

সায়্যিদ এখানে মোরালিটি এবং এথিক্সের মধ্যে পার্থক্য মুসাবিদা করছেন। ইয়াদ রাখা জরুরি যে, মশহুর জার্মান দার্শনিক ভিটগেন্সটাইন বলেছেন, কেউ যদি কোনোদিন এথিক্সের কেতাব মুসাবিদা করতে পারে, তবে সেই কেতাব বাকিসব কেতাবকে ধ্বংস করে দেবে। তাহলে বুঝতে হবে, এথিক্স জিনিসটা আসলে কী। সায়্যিদ বলছেন, মোরালিটি হচ্ছে ঐ জিনিস, যা যেকোনো সমাজে সর্বদা বিরাজ থাকে। প্রত্যেক সমাজেই আমরা জানি ভালো বা খারাপের নির্দিষ্ট সংজ্ঞার্থ আছে। এই সংজ্ঞার্থ সমাজ থেকে সমাজে, কাল থেকে কালে ভিন্ন। তবে প্রত্যেকটা সমাজেই ভাল-খারাপের একটা সংজ্ঞার্থ আছে। এই নির্দিষ্ট, স্থান এবং কাল সাপেক্ষ যে ভাল-খারাপ তার সাথে মোরালিটির রিশতা। অন্যদিকে, এথিক্স হচ্ছে সর্বদা বেহতরিন একটা সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। এথিক্স এই মানবিক ও ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ায় বাস্তবায়ন সম্ভব না। এথিক্স সর্বদা অবাস্তব এক অবস্থা—এক বেহতরিন সম্ভাবনা। এটা কোনো স্থান বা কাল দ্বারা সীমাবদ্ধ না।

শাপলা এরকমই এক এথিকাল বিষয়। শাপলার মুখ্য বিষয় হচ্ছে ইসলাম। মানুষ ইসলাম হেফাজতের জন্য শাপলায় জমায়েত হয়েছিল। তেরো দফা বা ব্লাসফেমির দণ্ডের দাবী এদিক-সেদিকে শোনা গেলেও শাপলার মূল আকর্ষণ ছিল ইসলামের হেফাজত। ইসলাম আসলে কী, কেমন ইসলাম—এ প্রসঙ্গে বাহাস শুরু হতে পারে, কিন্তু শেষ হবে না। শাপলা এই বাহাসে আগ্রহীও না। ইসলাম এক এথিকাল বিষয়। শাপলা সেই এথিকাল বিষয়ের হেফাজত করতে চায়। শাপলা জানে যে এই এথিক্স কখনোই নশ্বর দুনিয়ায় বাস্তবায়িত হবে না। কারণ এক প্রকার মরীচীকার মত এথিক্সের পেছনে শুধু ছোটাই মুমকিন; একে পাওয়া মুমকিন না। স্থান-কাল-সাপেক্ষে নির্দিষ্ট মোরালিটি হাসিল করা মুমকিন, কিন্তু কোনো মোরালিটিই তো এথিক্স না।

শাপলার সাথে শাহবাগের বড় তফাতটা এখানেই। শাপলা সব ধরণের সংশয় ছেড়ে ইসলামের এথিকাল ন্যাচারকে এলান করতে পেরেছে। শাপলা কোনো ভনিতার আশ্রয় নেয়নি। ইসলামের কোনো বাহ্যিক রুপ (অন্টিক মেনিফেস্টেশন) যেমন জুলমি ট্রাইবুনালে বাঙ্গালী নেতাদের নির্যাতন ও হত্যার প্রতিবাদ নিয়ে শাপলা চিন্তিত ছিল না। অন্যদিকে, শাহবাগ কখনোই সততার সাথে সেকুলারিজম প্রশ্ন আনতে পারেনি। শাহবাগকে তাদের সেক্যুলারিজমের একটা বাহ্যিক রুপ তথা বাঙ্গালী নেতাদের ফাঁসিতে (যেটাকে তারা যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি হিসাবে অভিহিত করে) আবদ্ধ করেছে। তারা সরাসরি সেক্যুলারিজমের কথা বলতে পারেনি। তাদেরকে বর্ণচোরার মত ছলের আশ্রয় নিতে হয়েছে। অন্যদিকে, শাপলা এ ধরণের কোনো ভনিতার আশ্রয় নেয়নি। শাপলা খুললাম খুল্লা ইসলামের এথিকাল ন্যাচার এলান করেছে।

শাপলার এথিকাল ন্যাচার বুঝতে পারলে আমরা শাপলা প্রসঙ্গে একটা কৌতুহলও নিবারণ করতে পারব। অনেকেই শাপলাকে দোষ দেন যে শাপলা ট্রাইবুনালের জুলুম প্রসঙ্গে নীরব ছিল। এটা সত্য হলেও এটা শাপলার দোষ না। এটা বরং শাপলার এথিকাল ন্যাচারের দিকেই ইঙ্গিত দেয়। শাপলা ইসলামকে হেফাজত করতে চেয়েছে। ইসলামের কোনো বিশেষ দিক যেগুলোকে আমরা অন্টিক মেনিফেস্টেশন বলতে পারি সেগুলিকে না। ট্রাইবুনালের জুলুম তো বটেই, দুনিয়ার যেকোনো বিশেষ জুলুমের বিরুদ্ধেই শাপলা কখনো সংঘটিত হতে পারেনি। শাপলা ঐ মুহুর্তেই তৈরী হয় যেই মুহুর্তে ইসলাম স্বব্যাখ্যাতা আকারে হেফাজতের দরকার পড়ে। ইসলাম কী বা কোনটা, তা নিয়ে বহু বাহাস থাকার পরও, যেটাই ইসলাম হোক ইসলামকে হেফাজত করতে হবে এই বোধ জাগ্রত হয়, তখন সেখানে শাপলা জন্ম নেয়।

শাপলার এথিকাল ন্যাচার বোঝা গেলেও এতে করে এই জনপদের মানুষ যে ট্রাইবুনালের জুলুমপ্রশ্নে দুর্গন্ধযুক্ত মোরালিটির পরিচয় দিয়েছে, সেই বিষয়টা এর পরও থেকেই যায়। শাপলা এইদিক থেকে শাহবাগের সাথে অনেক ওপরে। শাহবাগের সাথে শাপলার দ্বন্দ্বটা লাইক ফর লাইক কম্প্যারিজন থেকে উদ্ভূত হয় না। এক্ষেত্রে তাহলে দেখা যায়, পাক বাংলার জমিনে শাহবাগের কোনো যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী জন্মই নেয়নি। একাত্তর, যুদ্ধাপরাধ ও ট্রাইবুনালকে ঘিরে কেমালবাদীদের যদি থাকে শাহবাগ, তবে বাঙ্গালীর এ প্রসঙ্গে ছিল শুধু জামাত-শিবিরের হরতাল এবং ঝটিকা মিছিল। শাপলাকে শাহবাগের স্তরে নামিয়ে আনার মাধ্যমে একদিকে যেমন শাপলার অপমান করা হয়, তেমনই শাহবাগের মোকাবেলায় এই জনপদের সম্মিলিত না-কামিয়াবিকেও আড়াল করা হয়। এই সূত্র ধরেই অনেকে শাপলার ওপর অদ্ভূত আবদার করে বসেন। ভাবেন যে, শাপলার দায়িত্ব ছিল শাহবাগকে একাত্তরকেন্দ্রিক জুলুম করা থেকে বিরত রাখা। আবার অনেকক্ষেত্রে সমতাবিধানের জন্য শাহবাগকে একাত্তর থেকে আজাদ করে এটার অন্টোলজি দিয়ে বিচার করতে হয়। কারণ, তা না হলে আমাদের কাছে শাপলা-শাহবাগ দ্বন্দ্বের তসবিরটা স্বচ্ছ হয় না।

শাপলার মাধ্যমে পাক-বাংলার জনপদ ইসলামের এথিকাল ন্যাচারকে এলান করলেও শাহবাগের মোকাবেলায় শাপলার উত্থানের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে, একাত্তরকে ঘিরে ইসলামবিদ্বেষী যে জুলুম, সেই জুলুমের রক্ত এই জনপদের অনেক মানুষের হাতেই লেগে আছে। গোলাম আযমের ফাঁসির বিরোধিতা না করে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব এলান করাটা একদিক থেকে ঠিক আছে যে, ইসলাম সব সাময়িকতার উর্ধ্বে; কিন্তু তাতে করে তো গোলাম আযমের ওপর হওয়া নির্যাতনের দায় থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না।

তেরো সালে দুইটা ঘটনাই ঘটেছে। ইসলামের এথিকাল চরিত্রকে স্বীকৃতি দিয়ে শাপলা এসেছে। কিন্তু শাহবাগের ট্রাইবুনালের যে জুলুম, সেই জুলুমপ্রশ্নে এই জনপদের মানুষের নীরবতা জাতি হিসাবে আমাদের অপরাধী করে দিয়ে গেছে।

(পূর্বপ্রকাশ : চিরায়ত শাপলানামা সংখ্যা)

শেয়ার করুন