চিরায়ত

শাপলানামা : স্মৃতি খুঁড়ে বেদনা জাগানোর আখ্যান

শাপলানামা মূলত তেরোর সে উত্তাল আন্দোলন আর ফ্যাসিবাদ কর্তৃক তা দমনের এক দগদগে স্মৃতি বয়ে বেড়ায়। তখন আমার বুঝ সবে মেলতে শুরু করেছে। গাঁও গ্রামের ডানপিটে ছেলে। কামরাঙা রোদের এক শীতল বিকেলে যে অবাক তাকিয়ে দেখে, লাখো জনতার সম্মেলন। পুরানা আমলের টিভির ক্যামেরায় যতদূর চোখ যায়, মনে হচ্ছিল সাদার সমারোহ। তখন আমার কানে দূরঘন্টাধ্বনির মতো কেবল বাজতো এক আগুনপাখির আর্তস্বর। আমার চাচা আর ভাইয়ের সে কালো রাতের ধাওয়া খেয়ে ফিরে আসা, অপারেশনের বিভৎস ক্লিপ দেখে সবুজ হৃদয়ে জমে চেতনার বারুদ। জন্ম নেয় সুপ্ত দ্রোহ। যে ক্ষোভের বীজ বুনেছিল সে তেরোতে, তা টের পেতে পেতে বহুবছর কেটে যায়। বহুসময় উড়ে যায় হাওয়ায়। তারপর থেকেই আমি শাপলার কথা শুনলে উৎকর্ণ হয়ে উঠি। হারিয়ে যাই সে উত্তাল দিনগুলোর কুয়াশা-ঝাপসা স্মৃতিতে। আমি অনুভব করি শৈশবে পুষে রাখা ক্ষোভ। সে লেলিহান শিখা দাবানলের মতো ভষ্ম করে দেয় ভেতরজমিন। শাপলানামার পড়ার সময় বারবার আমায় তাড়া করে ফেরে সে দ্রোহ। আমি ভুলে যেতে চাই, তবু বারবার মানসপটে খলবলিয়ে উঠে সে বিভীষিকাময় রাতের দৃশ্যায়ন। এটাকে আমি কেবল আমার আত্নগত ভাবনা বা পাঠানুভূতি বলতে পারি।

গতবছর সে তাগিদে রশিদ জামিলের ‘বিশ্বাসের বহুবচন’, হাসান ইনামের সময়ের ছায়াবলম্বনে লেখা উপন্যাস ‘জলতরঙ্গ’ পড়েছি। আমাদের সে বেহাত হওয়া ইতিহাস আর ধৃত রক্তের আখ্যানের শোক বারবার আকুল করে তুলে আমায়। কপটতা, মোহ, আর অদূরদর্শীতা ভার নিয়ে বহু সময়ের পাটাতন পেরিয়ে এসেছি, শাপলানামা আমাদেরকে সেই যাপিত সময়ের বার্তাটুকু দিতে চায়।

শাপলানামার ব্যাপারে আমি ভীষণ আগ্রহী ছিলাম। গতবছর রমযানে এর ব্যাপারে প্রথম জানতে পারি, শাপলাবিষয়ক- হওয়ায় আগ্রহ বেড়ে যায় বহুমাত্রায়। অর্ডার দেওয়ার পর শুরু হয় অধীর ইন্তেজার। এতোটা আকুল হয়ে ওঠে হৃদয়, হাতে আসার আগের রাতে আমি স্বপ্নের ঘোরে দেখি শাপলানামা। ঘুম থেকে উঠে অস্পষ্ট কুয়াশার মতো মাথায় ঘুরঘুর করতে থাকে সেই স্বপ্ন।

শাপলানামায় প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকার, স্মৃতিগদ্য, গল্পসহ বহুমুখী লেখাজোঁকা আছে। পুরোটা আমি পড়িনি। তবে যা পড়েছি, তার মুখতাসার রিভিউ দিবো। ইন শা আল্লাহ।

আমি সর্বপ্রথম হাসান আজীজ ভাইয়ের লেখাটা পড়ি। শহরেপড়ুয়া এক তরুণের সময় অবলোকন আর ব্যক্তিগত স্মৃতি নিয়ে তার লেখা। স্মৃতিগদ্য বিভাগে যাবতীয় লেখার ভেতর তার লেখাটি আমার সুখপাঠ্য মনে হয়েছে। স্রোতেলা নদের মতো গদ্যে সে সময়ের পরিস্থিতির বয়ানে আমি অকুণ্ঠ ডুবে থেকেছি। মনে হচ্ছিল টাইম ট্রাভেলে আমি চলে গেছি সেই উত্তাল সময়ে। নিজ চোখে দেখছি মিছিল, জাগরন, বিপ্লব। বলা চলে, বেস্ট স্মৃতিগদ্য। আরেকটা স্মৃতিগদ্য আমায় পুড়িয়েছে বেশ, লেখকের নাম ইবরাহিম জামিল।

বাকিগুলোও ভালো ছিল, কিন্তু পঠিতগুলোর ভেতর হাসান ভাইয়েরটা দিলে গেঁথে আছে।

গল্পগুলো আমি বুঁদ হয়ে পড়েছি। অবাক করা ব্যাপার হলো, প্রতিটি গল্প সে সময়ে একেক দিকে আলোকপাত করেছে। প্রথম পড়ি অপরিচিত লেখিকার গল্প। বানোয়াট কিচ্ছা শুনিয়ে ঘটনার মোড় ঘোরানোর ফ্যাসিবাদি রুলস বেশ দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি।

এরপর পড়ি নাঈম সালেহের ‘ফ্লাশ আউট কারবালা’। উনাকে প্রথম চিনি ‘তুরুপের তাস’ উপন্যাসের মাধ্যমে। তার এ গল্প আমি শুধু শুরু করেছি, বাকিটুক নিয়ে গেছে গল্পবলার মুন্সিয়ানা। সে ধৃত রাতের চাক্ষুস বয়ান যেন করেছেন গল্পের মোড়কে। স্পট থেকে নিয়ে লাশবাহি ট্রাক—দীর্ঘ সময়ের বর্ণনা দিয়েছেন নিপুণতার সাথে। আমরা তার প্রোজ্জ্বল লেখক জীবন কামনা করি।

খুবাইব ভাইয়ের গল্প ‘পাঁচ পাঁচ তেরো’তে ফুটে ওঠে এক শহীদি পরিবারের গল্প। যারা সন্তান হারানোর শোকে কিংবা শহীদের বাবা মা হবার সুখ কারো কাছে প্রকাশ করতে পারেনি। এলাকার পাতি লীগ নেতাদের হুমকিতে ঘরের এককোণে পুষে রেখেছেন সে হৃদয় বিদারক দাস্তান। গল্পের শেষ মুহুর্তে যখন শহীদ মিকদাদের পিতা বলে উঠেন—‘জালিমরা শহিদদের কবরের অধিকারটুকুও কেড়ে নেয়’—তখন সেকালের এক ভয়াল পরিস্থিতি আমার মনের করোটিতে ভেসে ওঠে। জুলুম ধামাচাপা দিতে সে অনাচার ভেসে বেড়ায় চারপাশে। গল্প বলনে তার ভঙ্গিমা বেশ মনোমুগ্ধকর। তার এই যাত্রা দীর্ঘতর হোক। তার জন্য দুয়া করি।

বাইজিদ আহমাদ আমাদের গল্পের দর্পনে দেখাতে চায় এক গ্রাম্যবালকের কাহিনী। যে নবীপ্রেমের তাড়নায় ঢাকা আসে। আর হারিয়ে যায় অনন্তকালের তরে। গল্প বলায় তার আলাদা স্টাইল আছে। তবে তার এই গল্প সম্বন্ধে আমার ব্যক্তিগত মূল্যায়ন বেশ স্বাভাবিক। আমরা তার কলম থেকে আরো গল্প আশা করতে পারি।

সাইফ সিরাজ ভাইকে আমি প্রথম চিনি তার যাদুকর লিরিকের মাধ্যমে। তিনি ভালো গল্পকার—এটা বেশ পরে জানা হলেও কখনো পড়া হয়নি। গ্রামের স্কুলপড়ুয়া এক তরুণের দৃষ্টি থেকে তার গল্পের ডালপালা বিস্তৃত হয়। এরপর আন্দোলন, গ্রেফতার ও লড়াই নিয়ে গল্প এগিয়ে চলে আপনভঙ্গিমায়।

আহমাদ সাব্বির ভাইয়ের গল্প প্রথম পড়ি নবধ্বনিতে। এরপর থেকে তার লেখা বেশ আগ্রহ নিয়া পাঠের চেষ্টা করি। উনার গল্প শুরু করার পর মনে হয়েছিল, কোন প্রতীকী গল্প হবে বোধহয়। কিন্তু গল্পের শেষে এসে সে ভুল ভাঙ্গে। এক দুপুর রোদে যখন পথিক বুড়িকে তিনি পত্রিকার হেডলাইন পড়ে শোনান, তখন হনহন করে হেটে যান বৃদ্ধা। পেছন থেকে চেয়ে থাকে গল্পের কথক। এর মাঝেই ফুটে ওঠে শাপলা শোকরানা আর ঘৃণ্যতার আখ্যান।

সবশেষে আবরার ফাহিম। পাঠকপ্রিয় থ্রিলার ‘রক্তকরবী’ পড়ে আমি তার অনুরক্ত হয়ে পড়েছি। তার গল্পের নাম মনে পড়ছে না। তবে পুলিশি হয়রানি, আন্দোলনরতদের ব্যাপারে তাদের মনোভাবের দিকে এই গল্প থেকে আকর্ষিত হয় পাঠক। অন্যান্যদের থেকে নতুন একটা দিক নিয়ে লিখেছেন এ গল্প। তার গল্পকার জীবনের আরো উজ্জ্বলতা নেমে আসুক।

সালাউদ্দীন জাহাঙ্গীরের কবিতা বেশ লেগেছে আমার কাছে। তাছাড়া সাক্ষাৎকার, খুবাইব ভাইয়ের শাপলা বিষয়ক গ্রন্থালোচনা পড়ে উপকৃত হয়েছি। সাবের চৌধুরী রচিত সাক্ষাৎকার পড়ার ইচ্ছে আছে। শাপলা সম্বন্ধে কাজকর্ম, রচনা অপ্রতুল। শাপলানামার পথ ধরে এক্ষেত্রে একটা ধারা তৈয়ার হোক—এই কামনা রাখি। আমাদের চেতনাদ্বীপ্ত ইতিহাস প্রজন্মের সম্মুখে তুলে ধরবার এ এক মহৎ প্রয়াস। এই সৎসাহসের জন্য আমরা হৃদয়ের অতল থেকে খুবাইব মাহমুদকে ভালোবাসা সমর্পণ করছি। চিরায়ত আরো সমৃদ্ধ হোক।

শেয়ার করুন