মানুষটা আমি ঘরকুণো স্বভাবের। উঠানসমুদ্র পেরুবার ইচ্ছে কিংবা হিম্মত কোনোটিই ঠিক হয়ে উঠে না। দেশ ভ্রমণের ইচ্ছে হলে বইয়ের পাতায় মুখ গুজি; আমার বিশ্বভ্রমণ হয়ে যায়। নিজ জেলার দর্শনীয় স্থান কিংবা প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী মাদরাসা⎯কিছুই দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া। সেই আমিই এক সকালে ব্যাগ গুছিয়ে ময়মনসিংহের পথে বেরিয়ে পড়লাম। আম্মার উদ্বিগ্ন চেহারা, আব্বার অসন্তোষ আর মেঝো আপার মৃদু টিপ্পনি⎯ময়মনসিংহে বিয়ে করতে চাস না; ঘুরতে যাইতে এতো মজা কেন?⎯সব পেছন ফেলে⎯একা!
মামাত ভাই লুতফুল্লাহ ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে ইসলামিক স্টাডিজে পড়ছে। ওর সঙ্গে কথাবার্তা বলে রেখেছি আগেই। প্রথমে ওর কাছে গিয়ে উঠব। আনন্দমোহন এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরিয়ে দেখানোর দায়িত্ব ওর। বার কয়েক সিএনজি বদলে মটখোলা থেকে ময়মনগামী বাসে চরে বসলাম। পরের কয়েকটি ঘন্টা কাটল মার্কিন ‘অর্থনেতিক ঘাতক’ জন পার্কিন্সের ‘স্বীকারোক্তি’ পড়ে। বইটির বিষয়বস্তু বেশ আগ্রহ জাগানিয়া। আমেরিকা কীভাবে উন্নয়নশীল ছোট দেশগুলোকে উন্নয়নের মরিচিকা দেখিয়ে ভেতর থেকে ফোকলা করে দেয় এবং চিরদিনের জন্য নিজেদের দাসানুদাসে পরিণত করে তারই রোমঞ্চকর বর্ণনা। লেখকের দাবিমতে, আমেরিকার গোমড় পৃথিবীর সামনে উন্মোচিত করে তিনি মূলত বিবেকের দংশন থেকে মুক্তি খুঁজেছেন। কারণ তিনি নিজেও ঘাতকদলের সদস্য হিসেবে বহু দেশ ধ্বংসে ভূমিকা রেখেছেন। বইটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বারবার বেস্ট সেলার হয়েছে। তাতে কী? কোনো দেশ কি তার থেকে শিক্ষা নিয়েছে?
লুতফুল্লাহ কিছুদূর এগিয়ে এসে আমাকে স্বাগত জানায়। ওর মেসে ব্যাগ রেখে ফ্রেশ হয়ে আনন্দমোহন দেখতে বেরিয়ে পড়ি। তখন ঠিক দুপুর। কলেজের ভেতর-বাহির শিক্ষার্থীদের পদচারণায় সরগরম। প্রবেশদ্বারের দুইপাশে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং (পতিত) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা! উপরে বড় বড় অক্ষরে লেখা⎯জ্ঞানের জন্য এসো, সেবার জন্য বেরিয়ে যাও! ভেতরে দেয়ালগুলো ছেয়ে আছে গণতন্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের বিভিন্ন পোস্টার আর দেয়াললিখন দিয়ে। ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানটিতে যারা ছাত্র হয়ে থেকেছেন কবি নির্মলেন্দু গুণ তাদের অন্যতম। মহাজীবনের কাব্য আত্মজীবনীতে গুণ সেই দিনগুলোর সরস বিবরণ দিয়েছেন। শেষটা তার ভালো ছিল না। বহিস্কার হয়ে কলেজ ছাড়তে হয়েছিল। অথচ আজ গুণ যখন দেশের পরিচিতমুখ উইকিপিডিয়ায় কলেজের কৃতীছাত্রের তালিকায় তার নামও যুক্ত হয়ে গেছে! পুরনো আমলের ভবনগুলো ঘুরে দেখতে দেখতে সেসব কথা মনে পড়ল!
হাঁটতে হাঁটতে কলেজের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে এসে দাঁড়ালাম। ইতিউতি তাকিয়ে ঢুকে পড়লাম ভেতরে। কিন্তু থমকে যেতে হলো লাইব্রেরিয়ানের বাধায়। জানালেন, নিয়মতান্ত্রিক শিক্ষার্থীদেরই এখানে কার্ড করে ঢুকতে হয়। আর তুমি তো বহিরাগত! বললাম, কোনো বইপত্রে হাত দেব না। শুধু একটু ঘুরে দেখব। তারও অনুমতি মিলল না। ফলে অতৃপ্তির বেদনা নিয়ে বেরিয়ে এলাম।
আনন্দমোহনের ব্যর্থতা ঢাকতে চলে গেলাম ময়মনসিংহ পাবলিক লাইব্রেরী। বিশাল কামরায় সারি সারি তাকে সাজানো অসংখ্য বই। মাঝে টেবিল বিছিয়ে পড়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। শান্ত সমাহিত পরিবেশ। যেন কোলাহলমুখর ব্যস্ত নগরীর বুকে এক চিলতে ছোট্ট শান্ত পুষ্করণী। দীর্ঘ সময় নিয়ে ঘুরে ঘুরে বই দেখলাম। সবে ইফতা শেষ করে খেদমতে ঢুকেছি। উস্তাদ আব্দুল্লাহ মাসুম সাহেবের প্রভাব মস্তিস্ককে পুরোপুরি আচ্ছন্ন করে রেখেছেন। ফলে অর্থনীতি সংক্রান্ত কতগুলো বইয়ের তালিকা করলাম। ঢাকায় এসে রকমারি থেকে অর্ডার করব।
লাইব্রেরী থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন পার্কে। নদীতীরে বিশাল জায়গা নিয়ে সাজানো এই পার্ক। একপাশে আছে হিমু আড্ডা। ভেতর থেকে সাউন্ডবক্সে সুমধুর কোরআন তেলাওয়াত ভেসে আসছে। হিমুআড্ডার ভেতর কোরআন তেলাওয়াত; হুমায়ূন এই দৃশ্য দেখলে কি করতেন কে জানে?
জয়নুল আবেদীন পার্ক থেকে বের হয়ে গেলাম বিপিন পার্কে। এখানে বুলেট চা বেশ বিখ্যাত। চা না বলে বরং তেঁতুলের শরবত বলাই ভালো। তবে জিনিশটা মজার। জুহর পড়লাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে। এরপর সময় স্বল্পতায় যতোটা সম্ভব ঘুরে দেখলাম।
মেসে ফিরে দুপুরের খাবার খেয়ে পরবর্তী গন্তব্যে বেরিয়ে পড়লাম। ইচ্ছে ছিল এখান থেকে সরাসরি নেজামিয়া মাদরাসায় যাব। আমাদের নাজমুল ভাই সেখানে শিক্ষক। প্রতিষ্ঠানটির বেশ নামডাক শুনেছি। মুহতামিম সাহেবের ছেলের সঙ্গে সাক্ষাত হয়েছিল ঢাকায়, সাঈদ নুরসি পাঠচক্রে। তিনি জীবন ওয়াফক করেছেন বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসির জ্ঞান ও দাওয়াহ প্রচারের কাজে। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের অদূরে বিশাল অফিস নিয়ে গবেষণাকেন্দ্র চালিয়ে যাচ্ছেন। আমিনের সঙ্গে একদিন ঢু মেরে এসেছিলাম ওখানে। গল্প হয়েছে অনেক। লুতফুল্লাহর কাছ থেকে নেজামিয়ার ঠিকানা নিয়েও পরে ইচ্ছে বদল করলাম। ময়মনসিংহের খ্যাতনামা মুফতি ফজলুল হক রহ. এর বাড়ি পথেই পড়ে। শুনেছি মুফতি সাহেবের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা অনেক সমৃদ্ধ। তাছাড়া মাখজান মাদরাসাও সেখান থেকে কাছেই। ওদিকটা একবার ঘুরে যেতে হয়।
মুফতি সাহেবের বাড়ি যখন পৌঁছি মাগরিবের তখন বেশ খানিকটা সময় বাকি আছে। বাইরে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ চিৎকার চেচামেচির পর ভেতর থেকে আওয়াজ এলো, তিনি বাড়িতে নেই। সন্ধ্যার পর থাকতেও পারেন। কী করব ভাবতে ভাবতে এক মসজিদের সামনে এসে দাঁড়ালাম। সাত-পাঁচ না ভেবে ঢুকে পড়লাম ভেতরে। কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে গ্যাট হয়ে বসলাম। এক মুরুব্বির নজর পড়ল। কৌতুহলি চোখে তিনি আমার কাজবাজ পর্যবেক্ষণ করছিলেন। এ পর্যায়ে তিনি এগিয়ে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কোথা থেকে এসেছি। কোথায়ই বা যাব? আমি সব খুলে বললাম। ততক্ষণে আরও একজন এসে জুটেছেন। দুইজনে মিলে নানান সহমত-ভিন্নমত পর্ব সেরে শেষে একমত হলেন, আমার উচিত মাখজান মাদরাসায় চলে যাওয়া। ওখানেই মুফতি সাহেবকে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। যাওয়ার পথটাও পই পই করে বুঝিয়ে দিলেন। বললেন, হেঁটেই চলে যেতে পারবে। রিকশা নেওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমি তাদের চোখের আড়াল হয়েই রিকশা নিয়ে নিলাম। শুনেছি ময়মনসিংহের মানুষ কয়েক মাইল দূরের পথকেও অবলীলায় “এই তো সামনে” বলে ফেলতে পারেন। সুতরাং অচেনা এলাকায় রিস্ক নেওয়া ঠিক হবে না।
মাখজান মাদরাসা-মসজিদে মাগরিব পড়ে বার কয়েক চত্বরজুড়ে চক্কর দিলাম। কোথায় যাব বা কার কাছে কী জিজ্ঞেস করব কিছুই বুঝতে পারছি না। দক্ষিণ দিকের ভবনের নিচতলাতেই ইফতা বিভাগ। সঙ্কোচ ঝেড়ে ঢুকে গেলাম ভেতরে। বাংলাদেশের ইফতা বিভাগগুলো নিয়ে আমার এক রকম কৌতুহলি অনুসন্ধিৎসা রয়েছে। বিভাগগুলো সব এক নিয়মে চলে না। কোথাও রয়েছে দারুল উলুম দেওবন্দের প্রভাব, কোথাও দারুল উলুম করাচির, কোথাওবা বানুরি টাউনের। কেউ আবার কয়েকটির মিশ্রণে নতুন মানহাজ গড়ে নিয়েছেন। কেউ তামরিনে বেশি গুরুত্ব দেন, কেউ মোতাআলায়। কোথাও উরদু ফতোয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, কিছু প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণরূপে উরদু-নির্ভর। কেউ কেউ সমন্বয়ের চেষ্টা করেন। মৌলিক উত্তরটা আরবি উৎসগ্রন্থগুলো থেকে বের করার পর সমর্থনের জন্য উরদু ফতোয়ার হাওয়ালা যুক্ত করতে হয়। এটি মালিবাগ জামিয়ার নীতি। এসব কারণেই আমি ফতোয়া বিভাগ দেখলেই খোঁজ-খবর নেওয়ার চেষ্টা করি। মানহাজ দেখি। কিতাবপত্রের সংগ্রহ কেমন তাও জানার চেষ্টা করি।
এতোসব শোনার পর নিশ্চয়ই আপনাদের কৌতুহল হচ্ছে, মাখজান মাদরাসার ইফতা বিভাগ সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন কী? দুঃখিত, আপনাদের হতাশ করতে হচ্ছে। আমার স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত দুর্বল। ছয় বছর আগের ঘটনা এখন কেবলই অস্পষ্ট ছায়া হয়ে আমাকে বিভ্রান্ত করছে। ধরতে চেয়েও পারছি না। এতটুকু মনে আছে, সহজে অনুমতি পাওয়ার আশায় নিজের পরিচয় দিয়েছিলাম এভাবে, আমি ঢাকার একটি দারুল ইফতায় খেদমতে আছি। (তখন তালিমুল ইসলাম ইনস্টিটিউটে পড়াই) আপনাদের ইফতা বিভাগটা একটু ঘুরে দেখতে চাই। ছাত্ররা সোৎসাহে স্বাগত জানিয়েছিল। আমি ঘুরে ঘুরে কিতাবের সংগ্রহ দেখেছি। তামরিনের খাতায় নজর বুলিয়েছি। টুকটাক প্রশ্ন করে মানহাজও জেনে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। এরপর কোনো মন্তব্য না করেই বেরিয়ে চলে এসেছি।
অন্ধকার পথ ধরে আবার ফিরে এলাম মুফতি সাহেবের বাসায়। সৌভাগ্য, তিনি বাসায় আছেন। আমি পরিচয় দিলাম, এক তালিবুল ইলম। আপনার সঙ্গে সাক্ষাত করতে এসেছি। তিনি সাদরে ভেতরে নিয়ে গেলেন। বাড়ি কোথায়, কী করি এসব জিজ্ঞেস করলেন। এক ফাঁকে বলে ফেললাম, আমি মূলত আপনার কুতুবখানাটি দেখতে এসেছি। মুহূর্তে মুখখানি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, আমার কুতুবখানার খবর তুমি কীভাবে জানলে?
উত্তরের অপেক্ষা না করেই টেনে নিয়ে গেলেন দুতলায়। কয়েক কামরাব্যাপী বিশাল সংগ্রহশালা। খুটিয়ে খুটিয়ে সব দেখালেন। বিভিন্ন কিতাবের পরিচয় এবং সংগ্রহের ইতিহাস শোনালেন উৎসাহের সঙ্গে। এতদূর থেকে তার কুতুবখানা যিয়ারতে এসেছি, শুনেই তার মনে হয়েছে আমি বেশ ইলমপিপাসু কিতাবপাগল মানুষ। তাই খুব দ্রুতই মনের অর্গল খুলে দিলেন। আমিও তার বিভ্রান্ত দূর করার কোনো চেষ্টা করলাম না। শুধু উপভোগ করে যেতে লাগলাম।
কথায় কথায় তারাবি নামাজের বিনিময়ের প্রসঙ্গ এলো। মুফতি সাহেব ছিলেন বিনিময় গ্রহণ জায়েজ⎯এই মতের শক্তিশালী প্রবক্তা। কয়েক খাতা ভরে রেখেছেন এ সংক্রান্ত নানা উদ্বৃতি দিয়ে। আমাকে সেগুলো খুলে খুলে দেখালেন। বললেন, এরকম অনেক খাতা পড়ে আছে। কাজ করানোর লোক পাই না। একজনকে আমি নিজের টাকায় ল্যাপটপ কিনে দিয়ে খরচাপাতি দিয়ে কাজে রেখেছিলাম। তবুও থাকতে চায় না। ইচ্ছে করছিল নিজেই থেকে যাই। আর কিছু না হোক, একজন প্রাজ্ঞ মুফতির সান্যিধ্যে কিছু সময় কাটানোর সুযোগ তো পাব। জ্ঞানের সিলসিলায় মোলাযামাতুশ শায়েখ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দরসি ধারাবাহিকতার বাইরে এর চর্চা আমাদের মাঝে প্রায় নেই-ই বলা যায়।
মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ইশার আজানধ্বনী ভেসে আসতেই আমি সচকিত হয়ে উঠলাম। নেজামিয়া যেতে হবে। অচেনা পথ। রাত বেশি হলে বিপদে পড়ব। তাই বিদায় চাইলাম। তিনি আচমকা জিজ্ঞেস করে বসলেন, নামাজ কোথায় পড়বে? আমি খানিক থতমত খেয়ে গেলাম। এরপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দুটি উপদেশ দিলেন, যার একটিও আমি জীবনে ধরে রাখতে পারিনি। বলেছিলেন, কখনও নামাজের জামাত মিস করবে না। কোথাও যাওয়ার আগে জামাতের হিসাব মাথায় রেখে সময়সূচি সাজাবে। যেন কোনো অজুহাতেই জামাত মিস না হয়ে যায়। আর সবসময় ওজুর সঙ্গে থাকার চেষ্টা করবে।
ছোট কয়েকটি রিসালা হাদিয়া দিলেন। এর মধ্যে একটি ছিল মাসনুন দোয়ার সংকলন। বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসতেই পেছন থেকে আবারও ডাক দিলেন। আমার মোবাইল নাম্বার রাখলেন। এরপর খুবই আপন কাউকে বিদায় দিচ্ছেন, এভাবে দোয়া ও শুভকামনা জানিয়ে বিদায় দিলেন। কে জানত এটিই ছিল তার সঙ্গে আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ সাক্ষাত। ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তিনি ইন্তেকাল করেছেন। সেই সন্ধ্যার ছোট্ট সাক্ষাতটির কথা পরে মনে তিনি রেখেছিলেন কি না জানি না। কিন্তু আমি তো আমৃত্যু ভুলতে পারব না।
নেজামিয়া পৌঁছে দীর্ঘ গোসল দিলাম। সারাদিনের ক্লান্তি ধুয়েমুছে গিয়ে শরীর ফুরফুরে হয়ে গেল। নাজমুল ভাই ততক্ষণে রাতের খাবারের আয়োজন সাজিয়ে বসে আছেন। গল্পগুজবে খাবারপর্ব সাঙ্গ হলো। ছাত্ররা আসতে লাগলো একে একে। কেউ আরবি লেখা দেখাচ্ছে। কেউ আরবি শিক্ষার ব্যাপারে পরামর্শ করছে, কেউ সবক ঠিকঠাক করে নিচ্ছে। আমি পাশে বসে চুপচাপ দেখে যাচ্ছি। একটু কি আক্ষেপ জাগছে মনে?
একই প্রতিষ্ঠান থেকে তাখাসসুস ফিল-ফিকহ সম্পন্ন করে নাজমুল ভাই ঢুকেছেন এখানে, আর আমি একটি সদ্য প্রতিষ্ঠিত দারুল ইফতায়। ইফতাপড়ুয়া যেকোনো ছাত্রের মনে দারুল ইফতায় খেদমত এবং ফিকহ-ফতোয়া নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটানোর স্বপ্ন থাকে। আল্লাহ আমাকে সেই সুযোগ দিয়েছেন। তবু কেন নাজমুল ভাইকে দেখে আমার ভেতরে আক্ষেপের বেদনা? কেন মনে হচ্ছে শিক্ষকতার আসল স্বাদ কিতাব বিভাগেই?
(জানি না, সেই অকৃতজ্ঞতার আক্ষেপেরই শাস্তি কি না, মাত্র দুই বছরের মাথায় আল্লাহ এই নেয়ামত আমার থেকে তুলে নিয়েছেন। এরপর থেকে কিতাব বিভাগেই আছি। মাঝে মাঝে এসব ভেবে বুকে হাহাকার জাগে। কী নেয়ামত পেয়ে হারিয়েছি! অথচ নাজমুল ভাই? তার ভেতর ফিকহ-ফতোয়ার পিপাসা ছিল। তিনি আবারও এই ব্যস্ততায় ফিরে এসেছেন। আমি পড়েছি ছিটকে!)
নাজমুল ভাইয়ের পাশের কামরার শিক্ষক ছুটিতে ছিলেন। রাতে তার বিছানা দখল করে ঘুমিয়ে পড়ি। গোসলস্নাত শরীর আর পরিবেশের পবিত্রতার আবহ মিলিয়ে চমৎকার ঘুম হয়। ফজরে কারও ডাকাডাকি ছাড়াই চোখ খুলে যায়। ফজর পড়ে নাজমুল ভাই মাদরাসা ঘুরিয়ে দেখান। মাঝখানে বারান্দা রেখে দুইপাশে সারি সারি কামরা। নাজমুল ভাইয়ের কামরার বরাবর অপরদিকে জামিয়ার কুতুবখানা। গ্রামের মাদরাসা বিবেচনায় সংগ্রহ বেশ ভালো। ছাত্রদের আরবিচর্চার উপযোগি ছোট ছোট রিসালার বেশ ভালো সংগ্রহ রয়েছে। গ্রামের অনেক ঐতিহ্যবাহী মাদরাসায়ও এখনও কুতুবখানা-সংস্কৃতি গড়ে উঠেনি। মূলত কুতুবখানা-পাঠাগার এসব গড়ে উঠে যোগ্য চিন্তাশীল উস্তাদের হাত ধরে। গ্রামে যোগ্য উস্তাদ থাকলেও চিন্তাশীল উস্তাদের দারুণ অভাব। শহরে না থাকলে যোগ্যতার বিকাশ হবে না⎯এই চিন্তা থেকে প্রতিভাবান মানুষগুলো সব শহরে আশ্রয় খুঁজে। অগত্যা কেউ গ্রামে থেকে গেলেও উদ্যম হারিয়ে ফেলেন দ্রুতই। ফলে গ্রামগুলোতে এখনও পড়াশোনা একটা পর্যায় পর্যন্ত সচল থাকলেও ‘শিক্ষা’র হার খুবই নিম্নগামী!
সংক্ষিপ্ত নাস্তা সেরে দ্রুত বেরিয়ে পড়লাম। আরও দুই জায়গায় ঢু মারতে হবে⎯জামিয়া ইসলামিয়া এবং বড় মসজিদ মাদরাসা। উস্তাদ মাওলানা নজরুল ইসলাম সাহেবের মুখে হুজুরের আব্বা মাওলানা মিয়া রহ. এবং জামিয়া ইসলামিয়ার গল্প এতোবার শুনেছি যে, এতো কাছে এসেও দেখে না গেলে অতৃপ্তি থেকে যাবে। হাতে সময় কম। বাড়ি থেকে ফোন আসছে। দ্রুত ফিরতে হবে। দুই প্রতিষ্ঠানে পরিচিত কেউ নেই। তাই বাইরে থেকে যতটা সম্ভব দেখে ফিরে আসি। জামিয়া ইসলামিয়ায় গেইটের কাছাকাছি পুবদিকে দারুল ইফতা। সামনে দিয়ে কয়েকবার ঘুরেফিরেও ভেতরে ঢুকার সাহস করে উঠতে পারিনি। গত সন্ধ্যায় মাখজানে যে সাহস সঙ্গ দিয়েছিল সকাল না হতেই তা কেন সঙ্গ ত্যাগ করল বুঝতে পারলাম না। শেষে মিয়া রহ. এর কবর যিয়ারত করে বেরিয়ে এলাম।
বড় মসজিদ-মাদরাসা সম্ভবত ছুটি ছিল। নিচে কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে শেষে বাড়ির পথ ধরলাম।
মানুষটা আমি ঘরকুণো স্বভাবের। উঠানসমুদ্র পেরুবার ইচ্ছে কিংবা হিম্মত কোনোটিই ঠিক হয়ে উঠে না। দেশ ভ্রমণের ইচ্ছে হলে বইয়ের পাতায় মুখ গুজি; আমার বিশ্বভ্রমণ হয়ে যায়। নিজ জেলার দর্শনীয় স্থান কিংবা প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী মাদরাসা⎯কিছুই দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া। সেই আমিই এক সকালে ব্যাগ গুছিয়ে ময়মনসিংহের পথে বেরিয়ে পড়লাম। আম্মার উদ্বিগ্ন চেহারা, আব্বার অসন্তোষ আর মেঝো আপার মৃদু টিপ্পনি⎯ময়মনসিংহে বিয়ে করতে চাস না; ঘুরতে যাইতে এতো মজা কেন?⎯সব পেছন ফেলে⎯একা!
মামাত ভাই লুতফুল্লাহ ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে ইসলামিক স্টাডিজে পড়ছে। ওর সঙ্গে কথাবার্তা বলে রেখেছি আগেই। প্রথমে ওর কাছে গিয়ে উঠব। আনন্দমোহন এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরিয়ে দেখানোর দায়িত্ব ওর। বার কয়েক সিএনজি বদলে মটখোলা থেকে ময়মনগামী বাসে চরে বসলাম। পরের কয়েকটি ঘন্টা কাটল মার্কিন ‘অর্থনেতিক ঘাতক’ জন পার্কিন্সের ‘স্বীকারোক্তি’ পড়ে। বইটির বিষয়বস্তু বেশ আগ্রহ জাগানিয়া। আমেরিকা কীভাবে উন্নয়নশীল ছোট দেশগুলোকে উন্নয়নের মরিচিকা দেখিয়ে ভেতর থেকে ফোকলা করে দেয় এবং চিরদিনের জন্য নিজেদের দাসানুদাসে পরিণত করে তারই রোমঞ্চকর বর্ণনা। লেখকের দাবিমতে, আমেরিকার গোমড় পৃথিবীর সামনে উন্মোচিত করে তিনি মূলত বিবেকের দংশন থেকে মুক্তি খুঁজেছেন। কারণ তিনি নিজেও ঘাতকদলের সদস্য হিসেবে বহু দেশ ধ্বংসে ভূমিকা রেখেছেন। বইটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বারবার বেস্ট সেলার হয়েছে। তাতে কী? কোনো দেশ কি তার থেকে শিক্ষা নিয়েছে?
লুতফুল্লাহ কিছুদূর এগিয়ে এসে আমাকে স্বাগত জানায়। ওর মেসে ব্যাগ রেখে ফ্রেশ হয়ে আনন্দমোহন দেখতে বেরিয়ে পড়ি। তখন ঠিক দুপুর। কলেজের ভেতর-বাহির শিক্ষার্থীদের পদচারণায় সরগরম। প্রবেশদ্বারের দুইপাশে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং (পতিত) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা! উপরে বড় বড় অক্ষরে লেখা⎯জ্ঞানের জন্য এসো, সেবার জন্য বেরিয়ে যাও! ভেতরে দেয়ালগুলো ছেয়ে আছে গণতন্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের বিভিন্ন পোস্টার আর দেয়াললিখন দিয়ে। ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানটিতে যারা ছাত্র হয়ে থেকেছেন কবি নির্মলেন্দু গুণ তাদের অন্যতম। মহাজীবনের কাব্য আত্মজীবনীতে গুণ সেই দিনগুলোর সরস বিবরণ দিয়েছেন। শেষটা তার ভালো ছিল না। বহিস্কার হয়ে কলেজ ছাড়তে হয়েছিল। অথচ আজ গুণ যখন দেশের পরিচিতমুখ উইকিপিডিয়ায় কলেজের কৃতীছাত্রের তালিকায় তার নামও যুক্ত হয়ে গেছে! পুরনো আমলের ভবনগুলো ঘুরে দেখতে দেখতে সেসব কথা মনে পড়ল!
হাঁটতে হাঁটতে কলেজের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে এসে দাঁড়ালাম। ইতিউতি তাকিয়ে ঢুকে পড়লাম ভেতরে। কিন্তু থমকে যেতে হলো লাইব্রেরিয়ানের বাধায়। জানালেন, নিয়মতান্ত্রিক শিক্ষার্থীদেরই এখানে কার্ড করে ঢুকতে হয়। আর তুমি তো বহিরাগত! বললাম, কোনো বইপত্রে হাত দেব না। শুধু একটু ঘুরে দেখব। তারও অনুমতি মিলল না। ফলে অতৃপ্তির বেদনা নিয়ে বেরিয়ে এলাম।
আনন্দমোহনের ব্যর্থতা ঢাকতে চলে গেলাম ময়মনসিংহ পাবলিক লাইব্রেরী। বিশাল কামরায় সারি সারি তাকে সাজানো অসংখ্য বই। মাঝে টেবিল বিছিয়ে পড়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। শান্ত সমাহিত পরিবেশ। যেন কোলাহলমুখর ব্যস্ত নগরীর বুকে এক চিলতে ছোট্ট শান্ত পুষ্করণী। দীর্ঘ সময় নিয়ে ঘুরে ঘুরে বই দেখলাম। সবে ইফতা শেষ করে খেদমতে ঢুকেছি। উস্তাদ আব্দুল্লাহ মাসুম সাহেবের প্রভাব মস্তিস্ককে পুরোপুরি আচ্ছন্ন করে রেখেছেন। ফলে অর্থনীতি সংক্রান্ত কতগুলো বইয়ের তালিকা করলাম। ঢাকায় এসে রকমারি থেকে অর্ডার করব।
লাইব্রেরী থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন পার্কে। নদীতীরে বিশাল জায়গা নিয়ে সাজানো এই পার্ক। একপাশে আছে হিমু আড্ডা। ভেতর থেকে সাউন্ডবক্সে সুমধুর কোরআন তেলাওয়াত ভেসে আসছে। হিমুআড্ডার ভেতর কোরআন তেলাওয়াত; হুমায়ূন এই দৃশ্য দেখলে কি করতেন কে জানে?
জয়নুল আবেদীন পার্ক থেকে বের হয়ে গেলাম বিপিন পার্কে। এখানে বুলেট চা বেশ বিখ্যাত। চা না বলে বরং তেঁতুলের শরবত বলাই ভালো। তবে জিনিশটা মজার। জুহর পড়লাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে। এরপর সময় স্বল্পতায় যতোটা সম্ভব ঘুরে দেখলাম।
মেসে ফিরে দুপুরের খাবার খেয়ে পরবর্তী গন্তব্যে বেরিয়ে পড়লাম। ইচ্ছে ছিল এখান থেকে সরাসরি নেজামিয়া মাদরাসায় যাব। আমাদের নাজমুল ভাই সেখানে শিক্ষক। প্রতিষ্ঠানটির বেশ নামডাক শুনেছি। মুহতামিম সাহেবের ছেলের সঙ্গে সাক্ষাত হয়েছিল ঢাকায়, সাঈদ নুরসি পাঠচক্রে। তিনি জীবন ওয়াফক করেছেন বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসির জ্ঞান ও দাওয়াহ প্রচারের কাজে। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের অদূরে বিশাল অফিস নিয়ে গবেষণাকেন্দ্র চালিয়ে যাচ্ছেন। আমিনের সঙ্গে একদিন ঢু মেরে এসেছিলাম ওখানে। গল্প হয়েছে অনেক। লুতফুল্লাহর কাছ থেকে নেজামিয়ার ঠিকানা নিয়েও পরে ইচ্ছে বদল করলাম। ময়মনসিংহের খ্যাতনামা মুফতি ফজলুল হক রহ. এর বাড়ি পথেই পড়ে। শুনেছি মুফতি সাহেবের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা অনেক সমৃদ্ধ। তাছাড়া মাখজান মাদরাসাও সেখান থেকে কাছেই। ওদিকটা একবার ঘুরে যেতে হয়।
মুফতি সাহেবের বাড়ি যখন পৌঁছি মাগরিবের তখন বেশ খানিকটা সময় বাকি আছে। বাইরে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ চিৎকার চেচামেচির পর ভেতর থেকে আওয়াজ এলো, তিনি বাড়িতে নেই। সন্ধ্যার পর থাকতেও পারেন। কী করব ভাবতে ভাবতে এক মসজিদের সামনে এসে দাঁড়ালাম। সাত-পাঁচ না ভেবে ঢুকে পড়লাম ভেতরে। কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে গ্যাট হয়ে বসলাম। এক মুরুব্বির নজর পড়ল। কৌতুহলি চোখে তিনি আমার কাজবাজ পর্যবেক্ষণ করছিলেন। এ পর্যায়ে তিনি এগিয়ে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কোথা থেকে এসেছি। কোথায়ই বা যাব? আমি সব খুলে বললাম। ততক্ষণে আরও একজন এসে জুটেছেন। দুইজনে মিলে নানান সহমত-ভিন্নমত পর্ব সেরে শেষে একমত হলেন, আমার উচিত মাখজান মাদরাসায় চলে যাওয়া। ওখানেই মুফতি সাহেবকে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। যাওয়ার পথটাও পই পই করে বুঝিয়ে দিলেন। বললেন, হেঁটেই চলে যেতে পারবে। রিকশা নেওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমি তাদের চোখের আড়াল হয়েই রিকশা নিয়ে নিলাম। শুনেছি ময়মনসিংহের মানুষ কয়েক মাইল দূরের পথকেও অবলীলায় “এই তো সামনে” বলে ফেলতে পারেন। সুতরাং অচেনা এলাকায় রিস্ক নেওয়া ঠিক হবে না।
মাখজান মাদরাসা-মসজিদে মাগরিব পড়ে বার কয়েক চত্বরজুড়ে চক্কর দিলাম। কোথায় যাব বা কার কাছে কী জিজ্ঞেস করব কিছুই বুঝতে পারছি না। দক্ষিণ দিকের ভবনের নিচতলাতেই ইফতা বিভাগ। সঙ্কোচ ঝেড়ে ঢুকে গেলাম ভেতরে। বাংলাদেশের ইফতা বিভাগগুলো নিয়ে আমার এক রকম কৌতুহলি অনুসন্ধিৎসা রয়েছে। বিভাগগুলো সব এক নিয়মে চলে না। কোথাও রয়েছে দারুল উলুম দেওবন্দের প্রভাব, কোথাও দারুল উলুম করাচির, কোথাওবা বানুরি টাউনের। কেউ আবার কয়েকটির মিশ্রণে নতুন মানহাজ গড়ে নিয়েছেন। কেউ তামরিনে বেশি গুরুত্ব দেন, কেউ মোতাআলায়। কোথাও উরদু ফতোয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, কিছু প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণরূপে উরদু-নির্ভর। কেউ কেউ সমন্বয়ের চেষ্টা করেন। মৌলিক উত্তরটা আরবি উৎসগ্রন্থগুলো থেকে বের করার পর সমর্থনের জন্য উরদু ফতোয়ার হাওয়ালা যুক্ত করতে হয়। এটি মালিবাগ জামিয়ার নীতি। এসব কারণেই আমি ফতোয়া বিভাগ দেখলেই খোঁজ-খবর নেওয়ার চেষ্টা করি। মানহাজ দেখি। কিতাবপত্রের সংগ্রহ কেমন তাও জানার চেষ্টা করি।
এতোসব শোনার পর নিশ্চয়ই আপনাদের কৌতুহল হচ্ছে, মাখজান মাদরাসার ইফতা বিভাগ সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন কী? দুঃখিত, আপনাদের হতাশ করতে হচ্ছে। আমার স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত দুর্বল। ছয় বছর আগের ঘটনা এখন কেবলই অস্পষ্ট ছায়া হয়ে আমাকে বিভ্রান্ত করছে। ধরতে চেয়েও পারছি না। এতটুকু মনে আছে, সহজে অনুমতি পাওয়ার আশায় নিজের পরিচয় দিয়েছিলাম এভাবে, আমি ঢাকার একটি দারুল ইফতায় খেদমতে আছি। (তখন তালিমুল ইসলাম ইনস্টিটিউটে পড়াই) আপনাদের ইফতা বিভাগটা একটু ঘুরে দেখতে চাই। ছাত্ররা সোৎসাহে স্বাগত জানিয়েছিল। আমি ঘুরে ঘুরে কিতাবের সংগ্রহ দেখেছি। তামরিনের খাতায় নজর বুলিয়েছি। টুকটাক প্রশ্ন করে মানহাজও জেনে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। এরপর কোনো মন্তব্য না করেই বেরিয়ে চলে এসেছি।
অন্ধকার পথ ধরে আবার ফিরে এলাম মুফতি সাহেবের বাসায়। সৌভাগ্য, তিনি বাসায় আছেন। আমি পরিচয় দিলাম, এক তালিবুল ইলম। আপনার সঙ্গে সাক্ষাত করতে এসেছি। তিনি সাদরে ভেতরে নিয়ে গেলেন। বাড়ি কোথায়, কী করি এসব জিজ্ঞেস করলেন। এক ফাঁকে বলে ফেললাম, আমি মূলত আপনার কুতুবখানাটি দেখতে এসেছি। মুহূর্তে মুখখানি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, আমার কুতুবখানার খবর তুমি কীভাবে জানলে?
উত্তরের অপেক্ষা না করেই টেনে নিয়ে গেলেন দুতলায়। কয়েক কামরাব্যাপী বিশাল সংগ্রহশালা। খুটিয়ে খুটিয়ে সব দেখালেন। বিভিন্ন কিতাবের পরিচয় এবং সংগ্রহের ইতিহাস শোনালেন উৎসাহের সঙ্গে। এতদূর থেকে তার কুতুবখানা যিয়ারতে এসেছি, শুনেই তার মনে হয়েছে আমি বেশ ইলমপিপাসু কিতাবপাগল মানুষ। তাই খুব দ্রুতই মনের অর্গল খুলে দিলেন। আমিও তার বিভ্রান্ত দূর করার কোনো চেষ্টা করলাম না। শুধু উপভোগ করে যেতে লাগলাম।
কথায় কথায় তারাবি নামাজের বিনিময়ের প্রসঙ্গ এলো। মুফতি সাহেব ছিলেন বিনিময় গ্রহণ জায়েজ⎯এই মতের শক্তিশালী প্রবক্তা। কয়েক খাতা ভরে রেখেছেন এ সংক্রান্ত নানা উদ্বৃতি দিয়ে। আমাকে সেগুলো খুলে খুলে দেখালেন। বললেন, এরকম অনেক খাতা পড়ে আছে। কাজ করানোর লোক পাই না। একজনকে আমি নিজের টাকায় ল্যাপটপ কিনে দিয়ে খরচাপাতি দিয়ে কাজে রেখেছিলাম। তবুও থাকতে চায় না। ইচ্ছে করছিল নিজেই থেকে যাই। আর কিছু না হোক, একজন প্রাজ্ঞ মুফতির সান্যিধ্যে কিছু সময় কাটানোর সুযোগ তো পাব। জ্ঞানের সিলসিলায় মোলাযামাতুশ শায়েখ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দরসি ধারাবাহিকতার বাইরে এর চর্চা আমাদের মাঝে প্রায় নেই-ই বলা যায়।
মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ইশার আজানধ্বনী ভেসে আসতেই আমি সচকিত হয়ে উঠলাম। নেজামিয়া যেতে হবে। অচেনা পথ। রাত বেশি হলে বিপদে পড়ব। তাই বিদায় চাইলাম। তিনি আচমকা জিজ্ঞেস করে বসলেন, নামাজ কোথায় পড়বে? আমি খানিক থতমত খেয়ে গেলাম। এরপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দুটি উপদেশ দিলেন, যার একটিও আমি জীবনে ধরে রাখতে পারিনি। বলেছিলেন, কখনও নামাজের জামাত মিস করবে না। কোথাও যাওয়ার আগে জামাতের হিসাব মাথায় রেখে সময়সূচি সাজাবে। যেন কোনো অজুহাতেই জামাত মিস না হয়ে যায়। আর সবসময় ওজুর সঙ্গে থাকার চেষ্টা করবে।
ছোট কয়েকটি রিসালা হাদিয়া দিলেন। এর মধ্যে একটি ছিল মাসনুন দোয়ার সংকলন। বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসতেই পেছন থেকে আবারও ডাক দিলেন। আমার মোবাইল নাম্বার রাখলেন। এরপর খুবই আপন কাউকে বিদায় দিচ্ছেন, এভাবে দোয়া ও শুভকামনা জানিয়ে বিদায় দিলেন। কে জানত এটিই ছিল তার সঙ্গে আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ সাক্ষাত। ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তিনি ইন্তেকাল করেছেন। সেই সন্ধ্যার ছোট্ট সাক্ষাতটির কথা পরে মনে তিনি রেখেছিলেন কি না জানি না। কিন্তু আমি তো আমৃত্যু ভুলতে পারব না।
নেজামিয়া পৌঁছে দীর্ঘ গোসল দিলাম। সারাদিনের ক্লান্তি ধুয়েমুছে গিয়ে শরীর ফুরফুরে হয়ে গেল। নাজমুল ভাই ততক্ষণে রাতের খাবারের আয়োজন সাজিয়ে বসে আছেন। গল্পগুজবে খাবারপর্ব সাঙ্গ হলো। ছাত্ররা আসতে লাগলো একে একে। কেউ আরবি লেখা দেখাচ্ছে। কেউ আরবি শিক্ষার ব্যাপারে পরামর্শ করছে, কেউ সবক ঠিকঠাক করে নিচ্ছে। আমি পাশে বসে চুপচাপ দেখে যাচ্ছি। একটু কি আক্ষেপ জাগছে মনে?
একই প্রতিষ্ঠান থেকে তাখাসসুস ফিল-ফিকহ সম্পন্ন করে নাজমুল ভাই ঢুকেছেন এখানে, আর আমি একটি সদ্য প্রতিষ্ঠিত দারুল ইফতায়। ইফতাপড়ুয়া যেকোনো ছাত্রের মনে দারুল ইফতায় খেদমত এবং ফিকহ-ফতোয়া নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটানোর স্বপ্ন থাকে। আল্লাহ আমাকে সেই সুযোগ দিয়েছেন। তবু কেন নাজমুল ভাইকে দেখে আমার ভেতরে আক্ষেপের বেদনা? কেন মনে হচ্ছে শিক্ষকতার আসল স্বাদ কিতাব বিভাগেই?
(জানি না, সেই অকৃতজ্ঞতার আক্ষেপেরই শাস্তি কি না, মাত্র দুই বছরের মাথায় আল্লাহ এই নেয়ামত আমার থেকে তুলে নিয়েছেন। এরপর থেকে কিতাব বিভাগেই আছি। মাঝে মাঝে এসব ভেবে বুকে হাহাকার জাগে। কী নেয়ামত পেয়ে হারিয়েছি! অথচ নাজমুল ভাই? তার ভেতর ফিকহ-ফতোয়ার পিপাসা ছিল। তিনি আবারও এই ব্যস্ততায় ফিরে এসেছেন। আমি পড়েছি ছিটকে!)
নাজমুল ভাইয়ের পাশের কামরার শিক্ষক ছুটিতে ছিলেন। রাতে তার বিছানা দখল করে ঘুমিয়ে পড়ি। গোসলস্নাত শরীর আর পরিবেশের পবিত্রতার আবহ মিলিয়ে চমৎকার ঘুম হয়। ফজরে কারও ডাকাডাকি ছাড়াই চোখ খুলে যায়। ফজর পড়ে নাজমুল ভাই মাদরাসা ঘুরিয়ে দেখান। মাঝখানে বারান্দা রেখে দুইপাশে সারি সারি কামরা। নাজমুল ভাইয়ের কামরার বরাবর অপরদিকে জামিয়ার কুতুবখানা। গ্রামের মাদরাসা বিবেচনায় সংগ্রহ বেশ ভালো। ছাত্রদের আরবিচর্চার উপযোগি ছোট ছোট রিসালার বেশ ভালো সংগ্রহ রয়েছে। গ্রামের অনেক ঐতিহ্যবাহী মাদরাসায়ও এখনও কুতুবখানা-সংস্কৃতি গড়ে উঠেনি। মূলত কুতুবখানা-পাঠাগার এসব গড়ে উঠে যোগ্য চিন্তাশীল উস্তাদের হাত ধরে। গ্রামে যোগ্য উস্তাদ থাকলেও চিন্তাশীল উস্তাদের দারুণ অভাব। শহরে না থাকলে যোগ্যতার বিকাশ হবে না⎯এই চিন্তা থেকে প্রতিভাবান মানুষগুলো সব শহরে আশ্রয় খুঁজে। অগত্যা কেউ গ্রামে থেকে গেলেও উদ্যম হারিয়ে ফেলেন দ্রুতই। ফলে গ্রামগুলোতে এখনও পড়াশোনা একটা পর্যায় পর্যন্ত সচল থাকলেও ‘শিক্ষা’র হার খুবই নিম্নগামী!
সংক্ষিপ্ত নাস্তা সেরে দ্রুত বেরিয়ে পড়লাম। আরও দুই জায়গায় ঢু মারতে হবে⎯জামিয়া ইসলামিয়া এবং বড় মসজিদ মাদরাসা। উস্তাদ মাওলানা নজরুল ইসলাম সাহেবের মুখে হুজুরের আব্বা মাওলানা মিয়া রহ. এবং জামিয়া ইসলামিয়ার গল্প এতোবার শুনেছি যে, এতো কাছে এসেও দেখে না গেলে অতৃপ্তি থেকে যাবে। হাতে সময় কম। বাড়ি থেকে ফোন আসছে। দ্রুত ফিরতে হবে। দুই প্রতিষ্ঠানে পরিচিত কেউ নেই। তাই বাইরে থেকে যতটা সম্ভব দেখে ফিরে আসি। জামিয়া ইসলামিয়ায় গেইটের কাছাকাছি পুবদিকে দারুল ইফতা। সামনে দিয়ে কয়েকবার ঘুরেফিরেও ভেতরে ঢুকার সাহস করে উঠতে পারিনি। গত সন্ধ্যায় মাখজানে যে সাহস সঙ্গ দিয়েছিল সকাল না হতেই তা কেন সঙ্গ ত্যাগ করল বুঝতে পারলাম না। শেষে মিয়া রহ. এর কবর যিয়ারত করে বেরিয়ে এলাম।
বড় মসজিদ-মাদরাসা সম্ভবত ছুটি ছিল। নিচে কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে শেষে বাড়ির পথ ধরলাম।