চিরায়ত

বিদ্যার আকরে পরানের প্রীতি-পুষ্প

এক.

বই শব্দটি চোখের সামনে উদ্ভাসিত হলে ভাবনার আকাশজুড়ে পরিযায়ী পাখির মতোন উড়ে বেড়ায় বহুমাত্রিক বর্ণিল অনুভূতি ও বিচিত্র শব্দগুচ্ছ। অজস্র অক্ষর সহস্র শব্দভরা সমূহ শাদা-সোনালি পাতা যখন দুই মলাটের ভেতর আবদ্ধ হয়, তখনি ভাবনার ক্যানভাসজুড়ে বিজুলির শিখার মতো ভেসে ওঠে একটি বইয়ের চিত্র। এ বই নিয়ে বড়জন গুণীজনের চিন্তাভাবনা কুসুমিত-শিল্পিত সৌধে নির্মিত হয়েছে। বইপাঠ আর বইকেনার বহু উপকারের গীত শুনিয়েছেন। তাঁদের সুতীক্ষ্ণ চোখ তেজস্বী মননে বইয়ের হরেক রূপ চিত্রিত হয়েছে। বইকে অতীত আর বর্তমানের মাঝে বন্ধনের সাঁকো বলেছেন রবি ঠাকুর। বইয়ের চিরহরিৎ যৌবনকে ভেতর থেকে উপলব্ধি করেছিলেন কবি ওমর খৈয়াম। তাই তিনি বলতে পেরেছিলেন—

“রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে

প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে

বই, সে তো অনন্ত যৌবনা”।

বই আমার কাছে প্রিয়তমা প্রেয়সীর মতো। একজন প্রেমিক শিল্পী যেমন প্রেয়সীর রূপ অবয়বের চিত্র অঙ্কনে বিভোর, আমিও ভাব-কল্পনার আতিশয্যে অবগাহন করে অঙ্কন করি বইয়ের সুশ্রী-সুন্দর অবয়ব। সুতীক্ষ্ণ-সুচতুর চোখ। উজ্জ্বল প্রশস্ত ললাট। সুকোমল চিবুক। আগত দিনে প্রিয়তমা বধুর হরিণী চোখ দু’টো গ্রন্থ বানিয়ে পাঠের নেশায় বুঁদ হব না এ নিশ্চয়তা আমার নেই! আমার বইপ্রীতি প্রিয়তমার কাছে প্রবল বিদ্বেষের উপকরণ হবে তা কিছুটা আঁচ করতে পারি ইমাম যাহাবীর গভীর পাঠের আখ্যান পড়ে। বইপাঠে বুঁদহয়ে থাকতেন তিনি। তাঁর স্ত্রীর কাছে তাঁর এ বইপাঠ ছিল বিষের চেয়ে বিষাক্ত। বইকে তিনি সতীনের চেয়ে বড় শক্র ভাবতেন।

দুই.

হেরাগুহার নির্জন নিরালায় আসমানী দূতের আনিত সকল কিছুর একক অধিপতির প্রথম পবিত্র বাণীর মাঝেই ছিল পাঠের আদেশ। এ আদেশ কার্যে রূপ দিতে বইয়ের সংস্পর্শে আসি। আশৈশব বইপ্রীতি পরানের গহীনে পুষেছি। চির সবুজ তারুণ্যেও এসেও সতত প্রবহমান এ প্রীতির ফল্গুধারা। একটি নতুন বইয়ের ঘ্রাণে আমার ভেতরের ভাবনাশিশু তিরতির করে কেঁপে উঠে যেনবা মৃদু বাতাসে তিরতির করে কেঁপে উঠে পথের ধারের মাচান বেয়ে ঝুলে থাকা লতার মাঝে একটা ছোট্ট ঝিঙেফুল। অসংখ্য বইয়ের স্তূপের মাঝে আমার বসত। কিছু বই চারপাশে মুক্তোর মতো ছড়িয়ে না থাকলে বইয়ের রাজ্যে নিজেকে সম্রাট মনে হয় না। আমার শিথানের পাশে বই না থাকলে শান্তিতে ঘুম আসে না। মাঝে মাঝে বই বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। বইয়ে সঞ্চিত নতুন নতুন স্বাদ ও অভিনব রস বোধের গভীরে মস্তিষ্কের কোষে পুঞ্জীভূত করে পরিতৃপ্ত হই। বইপাঠ করে কেবল আনন্দে ভাসি না এক সুগভীর সুখকর তৃপ্তিকর অভিজ্ঞতায় ঐশ্বর্যশালী বৈভবশালী হয়ে উঠি। বইকেই করেছি স্নিগ্ধ রুচিবোধ, অনন্য সূক্ষ্ম চিরল অনুভূতি ও মননের

প্রতিভাস বিকাশের প্রতিভূ।

হরেক রঙের শখ-আগ্রহ দাফন করে প্রিয় লেখকদের সেরা বইগুলো সঞ্চয় করেছি। বইয়ের পাতায় পড়েছি বড়দের বইসংগ্রহের কিচ্ছা। পরনের কাপড় দিয়ে, আশ্রয়ের ঘর বিক্রি করে বই সংগ্রহ করেছেন তাঁরা। এমনই এক বইপ্রেয়সী ইবরাহীম হারবী। সবকিছুর বিসর্জনে গড়ে তুলেছেন বিশাল বইয়ের সৌধ। এক ব্যক্তি তাঁকে প্রশ্ন করেন “আপনি কীভাবে এতো বিপুল পরিমাণের বই সঞ্চয় করেছেন?” তিনি উত্তর দিলেন “নিজের শরীরের রক্ত-মাংস নিংড়ে এ বইগুলো সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছি।”

বইপাঠের আগ্রহ ও বাসনা জাগে মনীষীদের বইপাঠ ও বইকেনার উপাখ্যান পড়ে। মহামনীষী আবুল হাসান আলী নদভী শৈশবের বইপাঠ ও বইকেনার ইতিবৃত্ত পড়ে এ আগ্রহ আরও সুতীব্র, সুগভীর ও সুদৃঢ় হয়। তাঁর অমল মনের অমলিন অলিন্দে থরেবিথরে সজ্জিত ছিল বইয়ের প্রতি অগাধ টান ও গভীর ভালোবাসার ফুল-ফসল। নতুন বই কেনার জন্য তিনি বায়না ধরতেন। কাঁদতেন। বই কেনার জন্য ছোটবেলায় ফার্মেসিতে গিয়েছিলেন। ডাক্তার ভালো মনের মানুষ ছিলেন। তাকে বিনামূল্যে ধরিয়ে দিলেন ঔষুধের তালিকা। শিশু নদভীর মনে খেলে যায় আনন্দের দ্যুতি। শৈশবেই তিনি ব্যক্তিগত পাঠাগার গড়ে তোলেন। তাঁর পিতা ছিলেন অনেক বড় বিদ্বান ব্যক্তি। তাঁর কাছে অসংখ্য বই উপহার আসত। তিনি অপ্রয়োজনীয় বইগুলো একটি ঝুড়িতে রাখতেন। শিশু নদভী দরদী মালীর মত পরম যত্নে বইগুলো ওখান থেকে তুলে নিতেন। নিজের ব্যক্তিগত পাঠাগারে রাখতেন। তাঁর পাঠাগারের বইয়ের ওপর কচি হাতে কাঁচা কাঁচা অক্ষরে লিখে দিতেন ‘পাঠাগার আবুল হাসান’।

তিন.

নতুন বইয়ের তুলনায় পুরাতন বইয়ের প্রতি এক সহজাত টান অনুভব করি। বই নির্বাচনের দিক থেকেও পুরাতনকে অগ্রে রাখি। ঝকঝকে মলাটের নতুন বই তার সামগ্রিক সৌন্দর্য দিয়ে আমার চোখকে মোহিত করে ঠিক, তবে একটি ধুলোমলিন ও জীর্ণ কভারের বই আমার বোধে আধিপত্য বিস্তার করে।

আমি ভাবি, কেন নতুনকে উপেক্ষা আর অগ্রাহ্য করে পুরাতনের কাছে আমার সমর্পণ ও তার প্রতি গভীর আকর্ষণ। অনেক কারণের ভেতর উল্লেখযোগ্য কারণটি করোটিতে আসে—

পুরাতন বইয়ের ভাবের বৈভব এবং ভাষার বিভবই এ সহজাত টানের মূল কারণ। পুরান বইয়ের ক্ষতবিক্ষত পাতাগুলোর মাঝে পাই বিলুপ্ত বৃক্ষের সুরভিত পাতার ঘ্রাণ। এ বিলুপ্ত বৃক্ষের শাখা প্রশাখায় ছিল জ্ঞান ও প্রজ্ঞার হিরে-পান্না মুক্তা জহরত। লাইব্রেরির তাক থেকে ধুলোয় ধূসরিত বইগুলো ঝেড়ে মুছে কাছে টেনে নিই। লাইব্রেরিয়ান জিজ্ঞেস করতেন, কী বই লাগবে। কিন্তু আমি তাদের বইয়ের নাম বলতাম না। প্রিয় লেখকদের বইগুলো কষ্ট করে খুঁজে নেওয়াতেই পরম সুখ অনুভব করতাম। পুরাতন বইয়ের ভেতর বিপুল সাগ্রহে যে লেখকের সর্বোচ্চ বই সংগ্রহ করেছি তিনি সৈয়দ আলী আহসান। শ্মশ্রুর শুভ্রতার মতো তাঁর লেখার রেখায়ও থাকে

শুভ্রতার মিছিল। সাবলীল, স্রোতস্বিনী ও স্বাতন্ত্র্যবাহিত গদ্যের রূপকার। মেদমুক্ত ও মননশীল গদ্যের স্রষ্টা। তাঁর প্রায় বই ছাপা বন্ধ। দুর্লভ।

আন্দরকিল্লায় অনেক লাইব্রেরিতে ঘুরেছি। বহু বইয়ের তাকে দৃষ্টি ছড়িয়ে অনুসন্ধান করেছি তাঁর বই। এলোমেলো বইয়ের স্তূপেও ঘাঁটাঘাঁটি করেছি তাঁর পুরাতন বইগুলোর আশায়। অনলাইনেও অনুসন্ধানের এ প্রয়াস জারি ছিল বিভিন্ন বুকশপে বার্তা আদান প্রদানের সূত্রে। দ্বিগুণ মূল্যের বিনিময়ে সংগ্রহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। সৈয়দ আলী আহসানের অধিকাংশ বই সংগ্রহের কিসসায় ঝুলে আছে এক শুভাকাঙ্ক্ষীর নিখাঁদ ভালবাসার সেতারা আর উদ্দীপনার বিশাল

স্রোত। সে শাবাকা ও বিভিন্ন লাইব্রেরি বুকশপে ঘুরাঘুরি করে তাঁর পাঁচ ছয়টি বই সংগ্রহ করে দিয়েছে।

তার সমীপে কৃতজ্ঞতার গোলাপ অর্পণ করলে সে লজ্জিত হয়ে বলে, এসব ঠুনকো বিষয়। আহামরি কিছু নয়। এসবে মিশে আছে হৃদয়ের টান, প্রেম-প্রীতি।

অধ্যাপক আখতার ফারুক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফসহ আরও কিছু লেখকের বই আগ্রহের অগ্নিগিরি নিয়ে অনুসন্ধান করেছি। কিছু পেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছি। আর কিছুর সন্ধানে ব্যর্থ হয়েও মনখারাপকে প্রশ্রয় দিই না। আমি জানি, জীবনের বেলা ফুরাবার আগ পর্যন্ত আমাকে চঞ্চল ফড়িংয়ের মতো জ্ঞানের সবুজ ঘাস আর সুরভিত পুষ্প বইয়ের সন্ধানে ছুটতে হবে।

(পূর্বপ্রকাশ : চিরায়ত ২য় সংখ্যা)
শেয়ার করুন