চিরায়ত

পুরান বই : সাহিত্য ও জ্ঞান যেখানে ভরপুর

এই লেখাটা যখন শুরু করছি তখন কুয়াশাঢাকা সকাল। বসে আছি চা-স্টলের বেঞ্চিতে। গায়ে জ্যাকেট, পায়ে মোজা আর মুখে মাস্ক পরে। ডানহাতে চায়ের কাপ। বামহাতে ১৯৮৪ সালে শিল্পতরু প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত কবীর চৌধুরী কর্তৃক সঙ্কলিত ‘সাহিত্যকোষ’ নামক পুরোনো বইয়ের কপি। দারুণ একটা বই। সাহিত্যবিষয়ক নানা শব্দের বিশ্লেষণ, উৎপত্তি ও ব্যবহার নিয়ে আলোচনা। এই করোনাকালে সব দেশই মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করেছে। আর আমিও এখন মাস্ক পরে আছি। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, মাস্ক নিয়েও বিশ্লেষণ আছে এই বইয়ের আটাশি পৃষ্ঠায়।

‘Masque: মাস্ক: এক বিশেষ ধরনের জাঁকজমকপূর্ণ আনন্দ-অনুষ্ঠান। ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে শব্দটির প্রথম ব্যবহার দেখা যায়। মুখোশপরিহিত ব্যক্তিদের নৃত্যানুষ্ঠান সম্পর্কে তা ব্যবহৃত হয়। বেন জনসনের (১৫৭৩-১৬৩৭) মতে ‘মাস্ক’-কে আগে বলা হতো ‘Disguisings’ বা ‘ছদ্মবেশ ধারণ’। ‘মাস্ক’ হলো জাঁকজমকপূর্ণ উজ্জ্বল বর্ণাঢ্য রাজকীয় বিনোদন-অনুষ্ঠান। প্রথম এলিজাবেথ, প্রথম জেমস ও প্রথম চার্লসের যুগে ‘মাস্ক’ বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। কাব্যনাটক, গান, নাচ ও সঙ্গীত সবকিছু ‘মাস্ক’ তার ফর্মের মধ্যে ধারণ করতে চেয়েছিল। সেখানে জমকালো সাজ-পোশাকের ভূমিকা ছিলো গুরুত্বপূর্ণ। সপ্তদশ শতাব্দীর বিখ্যাত মাস্কগুলির মধ্যে রয়েছে বেন জনসনের ‘দি মাস্ক অব কুইনস’ (১৬০৯) এবং মিল্টনের ‘কোমাস’ (১৬৩৪) শেক্সপীয়রের নাটকের উপরও ‘মাস্ক’-এর প্রভাব লক্ষণীয়। স্মরণ করা যেতে পারে ‘দি টেম্পেস্ট’ (১৬১১) নাটকের চতুর্থ অঙ্কে জুনো এবং সেরেসের মাস্ক-এর কথা।’ [সাহিত্যকোষ, কবীর চৌধুরী, পৃষ্ঠা: ৮৮]

বইটি আমি সংগ্রহ করেছিলাম অনলাইন মাধ্যমে। ‘গ্রন্থ বিশ্ববিদ্যালয়’ নামক এক ফেসবুক গ্রুপ থেকে। এই গ্রুপ থেকে আমি আরো অনেক পুরোনো বই ক্রয় করেছি। ছাব্বিশ সেপ্টেম্বর দুই হাজার একুশ রবিবার। বাইতুল মোকাররম মসজিদের উত্তর পাশের ফুটপাথে গুটিকয়েক পুরোনো বইয়ের আলগা দোকান। একটি দোকানে আমি দাঁড়ানো অনেকক্ষণ ধরে। বিভিন্ন বই ঘাঁটছি-নাড়ছি। দোকানদারকে আগেই বলেছি ‘বই না নিয়ে যামু না, চিন্তা কইরেন না’। দোকানদার একটা মৃদু হাসি দিয়ে বললেন দেহেন, ‘যেইডা নিবেন বিশ ট্যাহা’। এভাবেই পথচারী মানুষকে অনবরত হাঁকছেন তিনি। আমার পুরোনো পেপারব্যাক, সাময়িকী, ঈদসংখ্যা, বিশেষসংখ্যা ইত্যাদি পড়তে ভালো লাগে। বইও পড়ি। সেই দিন আমি চারটা পুরোনো ঈদসংখ্যা ক্রয় করেছি মাত্র একশো তিরিশ টাকা দিয়ে। যেহেতু ঈদসংখ্যাগুলো বেশ মোটাসোটা, তাই এগুলোর দাম নতুন অবস্থায় দুইশো থেকে আড়াইশো হয়। এখানে দাম রাখছে মাত্র চল্লিশ টাকা করে। সাথে আরো কিছু সাময়িকী ও ‘আংটিহারা’ নামক সুন্দরবনের ভ্রমণোপন্যাসও কিনেছি। ‘অন্যপ্রকাশ’ থেকে দুই হাজার একুশের বইমেলায় প্রকাশ হওয়া ‘আংটিহারা’ উপন্যাসটি পুরোনো বইয়ের কাতারে ফেলা যায় না। কিন্তু এই স্টলে তার দাম মাত্র বিশ টাকা। কোনো লাইব্রেরি থেকে কিনলে নিশ্চিত তার গায়ের মূল্য পাঁচশো থেকে যা আসে তাই রাখা হবে। সর্বমোট আড়াইশো টাকার বই-পত্রিকা কিনে মাঝারি সাইজের একটা বাজারের ব্যাগে করে বাড়ি ফিরেছি। বাড়ি এসে সবাইকে জিজ্ঞেস করলাম এখানে কতো টাকার বই। কেউ পাঁচশো কেউ সাতশো বললো। আমি আড়াইশোর কথা বলতেই সবাই হতবাক হয়ে গেলো। এতো কম টাকায় এতোগুলো বই।

হ্যাঁ, নীলক্ষেত থেকে সবাই পুরোনো বই ক্রয় করেন। নীলক্ষেত পুরোনো বইয়ের বাজার হিসেবে বিখ্যাত। তবে ঢাকা শহরের অনেক অখ্যাত স্থানেও পুরোনো বই কিনতে পাওয়া যায়।

ভোলার সাইফুল ইসলাম ভাই থাকেন কল্যাণপুরের নতুন বাজার এলাকায়। আমার তাবলিগের সাথী। একজন সাদাসিধে সজ্জন মানুষ। সেখানে তিনি পুরোনো বই-পত্রিকা কিনে কেজিদরে বিক্রি করেন। তার ওখানেও অনেক মূল্যবান বই-পত্রের ছড়াছড়ি দেখেছি। সাইফুল ইসলাম ভাইকে বলেছি

‘আরেকদিন এসে আপনার কাছ থেকে কেজিদরে বই কিনে নিয়ে যাবো পড়ার জন্য’। তিনি মুচকি হাসলেন আর বললেন ‘মাইনসে নিয়া মজার প্যাকেট বানায় আর আফনে পড়বেন?’ বললাম ‘হ্যাঁ, পড়ার জন্যই নিমু’।

২.

ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আউটবই পড়ার বাতিক আছে আমার। এই যে এতো এতো দরসি কিতাব তা কতোক্ষণ পড়তে ভালো লাগে! আউটবইয়ের প্রতিই সাধারণত সবার আগ্রহ বেশি। আমার আউটবই পড়ার অভ্যেস রাতের ভুতুড়ে নির্জনতাকেও হার মানিয়েছে। আর এ কারণে উস্তাদগণ ও মা-বাবা কম বকেননি। সেইসব বকাঝকার জ্বলুনি তখনি মাটিচাপা দিয়ে আমি আমার পড়া চালিয়ে গেছি। মসজিদের বারান্দায় বসে। একা একা অজুখানায়। পুকুরঘাটের সিঁড়িতে। নবনির্মিত ভবনের নিরালা ছাদেও। আরো যে কতো শতো জায়গা আমার পড়ার সাক্ষী। বাসে বসে পড়তে পড়তে কখন যে আমার নির্ধারিত স্টেশন ছাড়িয়ে পরের সিগন্যালে নেমেছি, তাও তো স্মরণযোগ্য।

রাত দশটায় বাতি নিভিয়ে দিয়েছেন হাফেজ সাহেব হুজুর। শুধু ডিমলাইটের রঙিন মিহি আলোই এখন সম্বল। তবুও পড়া বাদ দিই কী করে। এভাবেই অনেকদিন পড়লাম। ফলাফল চোখের সমস্যা। পরীক্ষা-নিরিক্ষার পর ডাক্তার পরিয়ে দিলেন চশমা। সে চশমা আজো চোখ দুটিকে গাইড করে। আমি প্রচুর পড়তাম। নিজের বই কেনার সামর্থ না থাকলেও ধার করে পড়তাম। এখনো আমি পুরোনো মাসিক আদর্শ নারী ও রাহমানী পয়গাম হাতড়ে বেড়াই। এ পত্রিকা দুটোই আমার লেখালেখির ভিত গড়ে দিয়েছে। আমার পুরোনো ‘আঁধার রাতের বন্দিনী’, ‘আঁধার রাতের মুসাফির’, ‘ঈমানদীপ্ত দাস্তান’, ‘মরণজয়ী মুজাহিদ’, ‘স্পেনের রূপসী কন্যা’, ‘ইউসুফ বিন তাশফিন’, ‘অপারেশন মাজার-ই-শরিফ’, ‘রক্তাক্ত ভারত’, ‘ভেঙে গেলো তলোয়ার’, ‘ভারত অভিযান’, ‘শয়তানের বেহেশত’ ইত্যাদি বইয়ের ঘ্রাণ শুঁকি। এনায়েতুল্লাহ আলতামাস ও নসীম হিজাযীর উপন্যাসসমগ্রসহ তখনকার সুখপাঠ্য ইসলামিক উপন্যাসগুলোই আমার বইপাঠজগতে পদার্পণের উৎস-গ্রন্থ। একেকটা উপন্যাসের মুহুর্মুহু উত্তেজনা আমাকে থামতে দিতো না। খাবার কই, গোসল কই, রাতের ঘুম কই সব ভুলে এক অষ্টপ্রহরপাঠক বনে গিয়েছিলাম। ঔপন্যাসিক শফীউদ্দীন সরদারের বেশ ভক্ত ছিলাম। তাঁর উপন্যাস কেনো জানি অন্যরকমভাবে টানতো। বাংলায় আরবি-উর্দু-ফর্সি শব্দ সম্ভবত সবচে বেশি তিনিই ব্যবহার করতেন। তাঁর উপন্যাসের প্রধান পটভূমি হলো বাংলা মুলুকের প্রাচীন ইসলামি ইতিহাস-ঐতিহ্য। যে কারণে ইসলামি মহলে তাঁর বেশ কদর ছিলো। তাঁর লেখা ‘মুসাফির’ ও সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘মুসাফির’ দুটোই আমার সংগ্রহে আছে। তবে সৈয়দ মুজতবার বিলেতি মুসাফিরটা একটা ভ্রমণকাহিনি। বেশ রম্যভাষায় লিখিত। আর শফীউদ্দীন সরদারের মুসাফির আচরণে ও কাহিনিবিন্যাসে রম্যরচনার ছোঁয়া পেয়েছে ধরা যায়। এর বাইরেও কি কম পড়েছি? আল মাহমুদের ‘পানকৌড়ির রক্ত’ কতোবার যে পড়েছি তা তো মনেই নেই। নরসিংদী জেলা

গ্রন্থাগারে সপ্তাহে দু-একদিন না গেলে আমার হতোই না। বুকসেলফের চিপাচাপা থেকে পুরোনো বইগুলো বের করতাম। ধুলোবালি ঝেড়ে আগে বইয়ের ঘ্রাণ শুঁকে নিতাম। এটা আমার অভ্যেস। নতুন পুরাতন যে কোনো বই-কিতাব হাতে আসুক আগে তার ঘ্রাণ নিতে হবে তারপর পড়া। কুখ্যাত আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর ‘নির্বাসিতের জার্নাল’ ও ‘ধলেশ্বরির বাঁকে বাঁকে’ পড়ে আমার রাজনৈতিক চিন্তাশক্তি অনেকটাই প্রসারিত হয়েছে। যদিও সেকুলার মার্কা লেখাজোখা ও দিনলিপি দিয়ে বৃহৎ দুটি বই প্রকাশ হয়েছে তার। তবে তা সুখপাঠ্য ও জ্ঞানসমৃদ্ধ। এই পাঠাগারে আমি এখনো মাঝে মাঝে যাই। পুরোনো বইয়ের জায়গায় কতো নতুন বই এসেছে। কিন্তু আমি খুঁজে খুঁজে পুরোনো বই-ই বের করে পড়ি। আল মাহমুদের ‘প্রেমের কবিতাসমগ্র’ বার বার পড়ছি। আহা, প্রেম কতোটা বর্ণনাহীন। আল মাহমুদের ভাষায়—

সিজদায় পড়ে থাকি। তোমাকে যাচনা করে মন

তসবী ঘুরিয়ে বলি, দাও তাকে। নেকাব সরালে যার নীল

তিলের চিহ্নের জন্য তড়পায় আমার নিখিল

কিংবা হৃদয়ে বসে লজ্জাহীন মাছির গুঞ্জন।

[নেকাব: প্রেমের কবিতাসমগ্র]

তুমি আমার রাত্রি, আমার অমানিশা

আমি তোমার ছোট্ট কালো জোনাক পোকা,

এইতো আলো, এইতো কালো, নেই যে দিশা

আমি তোমার রুদ্ধদ্বারে একটি টোকা।

[বেহায়া সুর: প্রেমের কবিতাসমগ্র]

কিংবা ‘শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা’য় আছে প্রেমের নিখুঁত বুনন। তাঁর ভাষায়—

অবশ্য রোদ্দুরে তাকে রাখবো না আর

ভিনদেশি গাছপালার ছায়ায় ঢাকবো না আর

তাকে শুধুই বইবো বুকের গোপন ঘরে

তার পরিচয়? মনে পড়ে মনেই পড়ে।

[প্রেম: শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা]

১৯৭৯ সালে প্রকাশিত এই কবিতার বইটি আমার প্রিয় একটি বই। নির্মলেন্দু গুনের ‘রাজনৈতিক কবিতা’ [প্রকাশকাল: ১৯৮৯] ‘সুকান্তের কবিতাসমগ্র’ [প্রকাশকাল: ১৯৯২] ‘মহাদেব সাহার শ্রেষ্ঠ কবিতা’ [প্রকাশকাল: ১৯৯৮] সবগুলো বইয়েরই পাতা ছিঁড়ে গেছে। টিশ আলগা হয়ে গেছে। বইগুলো এ অবস্থায়ই কুরিয়ারে ক্রয় করেছিলাম। জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ ও ‘কাজী নজরুল ইসলাম-এর পঞ্চকাব্য’ এই তো সেদিন সংগ্রহ করলাম। আরো সংগ্রহ করেছি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র বিখ্যাত দুটি উপন্যাস ’লালসালু’ ও ‘কাঁদো নদী কাঁদো’। বাংলা সাহিত্যকে গাইড করছে যে বইগুলো, সেসবের

মধ্যে ‘ফেলুদা সমগ্র’, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ও অনলাইনে সংগ্রহ করেছি। রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছ’ সংগ্রহ করেছি সুদূর নওগাঁ থেকে। সাতশো পৃষ্ঠার বিশাল বই কুরিয়ার খরচসহ মাত্র দেড়শো টাকা নিয়েছেন ভাইটি। এতে সর্বমোট গল্প আছে ১০৩ টি।

ডা: লুৎফর রহমানকে কেউ চেনেন? একজন অপ্রসিদ্ধ সাহিত্যিক। পেশায় ছিলেন ডাক্তার ও শিক্ষক। ১৯৬৫ সালে তিনি মারা যান। তাঁর বেশ ক’টি সাহিত্যের রচনাসমগ্র প্রকাশ হয়েছে। আমার কাছে তার যে সমগ্রটি আছে তা প্রায় সাড়ে সাতশো পৃষ্ঠার। সাতটি প্রবন্ধ, পাঁচটি উপন্যাস, সাতটি ছোটগল্প

ও সাতটি অন্যান্য রচনা নিয়ে বইটি এক সাহিত্যভাণ্ডারের যথাযোগ্য আসন পেতে পারে। সাহিত্য ও লেখালেখির নিখুঁত অনেক খোরাকই আমি এ বই থেকে গ্রহণ করেছি।

১৯৮৪ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত সমরেশ মজুমদারের উপন্যাস ‘কালবেলা’ যেনো সব কালেই মণিমুকুট মাথায় সাহিত্যের বাজারে মধ্যমণি। ১৯৯৩ সালের তৃতীয় বাংলাদেশ সংস্করণের পুরোনো কপি আমার সংগ্রহে বিদ্যমান। বইটি পড়েছি। কথাসাহিত্যে সমরেশ মজুমদার আসলেই দারুণ ছিলেন। শঙ্খ ঘোষের গদ্যবই ‘জার্নাল’ সাহিত্যনবিশ যে কারোরই পড়া উচিত। গদ্যের জড়তা কাটাতে এবং নিখুঁত ঝরঝরে গদ্য লিখতে এ বই অনেকটাই উপকারী।

৩.

দুই হাজার পনেরো সাল। মারকায যায়েদ বিন সাবেতে আদব পড়ি। তখন কেবল আরবি নিয়েই যতো কারবারি। বছরের শুরুতেই ব্যক্তিগত মুতালার জন্য পেয়ে গেলাম ড. হামেদ আহমাদ তাহেরের লেখা ‘কাসাসুল আমবিয়া’ কিতাবটি। ছোটদের উপযোগী এ বইটি আরবি সাহিত্যের সেরা বই। পুরোনো ছেঁড়া ছেঁড়া পাতা। পড়ছি যতো ততই নতুন শব্দ, বাক্য ও স্বাদ-রস পাচ্ছিলাম পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়। কিতাবটি একটু মেরামত করে নিলাম আঠা-গাম লাগিয়ে, যেনো পৃষ্ঠাগুলো একেবারে আলগা হয়ে না যায়। অর্ধেক পড়তে না পড়তেই মাথায় খেলে উঠলো কিতাবটি অনুবাদের ফিকির। শুরুও করে দিলাম অনুবাদ। এক তৃতীয়াংশ অনুবাদ শেষও করেছি। হঠাৎ একদিন

অনুবাদলেখা খাতাটি উধাও হয়ে গেলো। আমার তো কান্না এসে গেছে। যেনো রাজ্য হারিয়ে পথে বসেছি। এরপর আর অনুবাদ করিনি। তবে পুরোনো অনেক আরবি সাহিত্যের বই-কিতাব মুতালা করেছি।

জগদ্বিখ্যাত ‘মাকামাতে হারীরী’ সময় পেলেই পড়তে বসি। সাথে নিই নতুন মাকামাত ‘মাকামাতে আয়েয আল কারনি’। যুগবিচারে দুই মাকামাতই শ্রেষ্ঠ ও অতুলনীয়।

শরহে বেকায়ার বছর মাদরাসার লাইব্রেরি থেকে নিয়ে অনেক পুরোনো বই পড়েছিলাম সাইয়েদ আবুল হাসান আলি নদবির ‘পাঁ জাঁ সুরাগে জিন্দেগি’র পুরোনো অনুবাদ যা অনুবাদ করেছেন, মাওলানা আবুল কাসেম মুহাম্মদ ছিফাতুল্লাহ। ১৯৯৩ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন তা প্রকাশ করেছিলো। ‘আহমদ দিদাত রচনাবলি’ কতো আগ্রহের সাথে পাঠ করেছি। পাঠ করেছি ফকীহ আবু লাইস সমরকন্দীর ‘তাম্বীহুল গাফেলীন’। যার বাংলা করেছেন নরসিংদীর কৃতিসন্তান, বীর মুক্তিযোদ্ধা শাইখুল হাদিস মাওলানা বশীর উদ্দীন দা: বা:।

দেকার্তে বলেছিলেন ‘বই পড়া মানে, গত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মানুষদের সাথে কথা বলা’। তার মানে পুরোনো বইই পৌঁছে দেবে গত শতাব্দীর কাছে। আপনি যতো পুরোনো ও প্রাচীন বই পাঠে রাখবেন, ততই আরো নতুন ও ভিন্নধারার বই লিখতে পারবেন। বাহ্যিক অনুজ্জ্বল পুরোনো বই আপনাকে শত শত ঔজ্জ্বল্যে ভরা বই লিখতে সাহায্য করবে।

তরুণ লিখিয়েরাও গত শতাব্দীর সংগ্রামী লেখক, কবি, সাহিত্যিকদের মেহনত, শ্রম ও চেষ্টায় অনুপ্রাণিত হবেন না? তাহলে পড়ে ফেলুন আল মাহমুদের ‘বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ’ ও মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের ‘জীবনের খেলাঘরে’। এ বই দুটো আমি ধার করে পড়েছি।

আমার মনে আছে। ছোটবেলায় পাশের বাড়ি থেকে বলে-কয়ে পড়তে এনেছিলাম, পুরোনো ছেঁড়াফাটা ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি’, ‘চে গুয়েবেরার ডায়েরি’, ‘আমি হিটলার বলছি’, ‘শেক্সপীয়র রচনাসমগ্র’, ও মাইকেল এইচ হার্টের ‘দি হান্ড্রেড’। দেদার পড়ে

গেছি এ বইগুলো। যদিও অনেক কিছুই বুঝিনি তখন স্বল্পবয়সি হওয়ার কারণে। কিন্তু এ পড়ায় আমি দিবানিশি পড়তে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। পুরোনো বই তাই আগ্রহ করেই পড়তে বসি।

(পূর্বপ্রকাশ : চিরায়ত ২য় সংখ্যা)
শেয়ার করুন