চিরায়ত

ঝরিবার আগে হেসে চলে যাব

শিমুলবাঁক গ্রামে আমাদের বাড়িটা ছিল গাং লাগোয়া। ঘরের দরোজায় দাঁড়ালে দেখা যেত ধনু গাং—নাব্য, স্রোতময় ও ঢেউখেলানো। দিনমান তাতে চলাচল করত ডিঙি, ট্রলার, লঞ্চ, কার্গো ও স্টিল বডির নৌকা। তখন আমরা অবাক শৈশবের চৌকাঠ মাড়িয়ে দুরন্ত কৈশোরের মাঠজুড়ে ছুট দিয়েছি। দেখতাম, কোনো কোনো সন্ধ্যায় গাঙের ঘাটে নোঙর করত মালবাহী জলযানগুলো। এগুলোর বেশির ভাগ ছিল স্টিল বডির নৌকা। পেটে ধানের গোলার মতো গভীর গর্ত, তাতে বোঝাই থাকত নানা ধরনের পাথর। ভর সন্ধ্যায় খেলার পাঠ চুকিয়ে দলবেঁধে ঘাটে যেতাম হাতমুখ ধুতে। তখনই দেখতে পেতাম নৌকাগুলোকে। পাথরের নৌকা দেখে আমাদের চঞ্চল মন খুশিতে ডগমগিয়ে উঠত। নৌকায় উঠে হাফপ্যান্টের পকেট আর গেঞ্জির কোঁচড়ে তুলে নিতাম ইচ্ছে মতো পাথর। এগুলো ছিল আমাদের খেলার উপকরণ। সেইসব পাথর জমানোর স্মৃতি আজও আমাকে আনন্দে উদ্বেলিত করে।

গণমাধ্যমে ফিলিস্তিন বিষয়ক যত খবর পড়ি, আমার চোখ খুঁজে ফিরে একটি শব্দ—পাথরশিশু। এটি আমাকে মনে করিয়ে দেয় এ মায়ামেদুর স্মৃতিটুকু, যার রোমন্থন অবচেতনভাবে হৃদয়কে আবেশিত করে। হ্যাঁ, পাথরশিশু—আতফাল আল-হিজারা—এটি এক মহিমান্বিত অভিধা, যার গৌরবময় অধিকারী ফিলিস্তিনের শিশু-কিশোররা। ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ওরা সবসময় অকুতোভয়। আমরা পাথর জমাতাম গাঙের পানিতে ঢিল ছুঁড়ে বুদ্বুদ তোলার জন্য আর ফিলিস্তিনের শিশু-কিশোররা পাথর সংগ্রহ করে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের সমুচিত জবাব দিতে। কী প্রবল বীরত্বপূর্ণ এ লড়াই! প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে অসীম সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যায় ওরা। একে অসম যুদ্ধ বলার কোনো সুযোগ নেই। এটা ইন্তিফাদা—ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন। এ আন্দোলনের প্রদীপ্ত সেনানী ফিলিস্তিনের পাথরশিশুরা।

ইন্তিফাদার সময় সমগ্র ফিলিস্তিন জুড়ে সৃষ্টি হয় এক অভাবনীয় গণজাগরণ। এ জাগরণ শিশু থেকে বৃদ্ধ প্রতিটি ফিলিস্তিনির হৃদয়ে জাগিয়ে তুলে টগবগে তারুণ্য; এর সৌররশ্মি যেদিকে সম্পাত করে, সেদিকটা জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যায়। বিশেষ করে পশ্চিম তীরের অধিবাসীরা সবচেয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠে। পুতুল সরকারের শাসনাধীন তারা। প্রতিনিয়ত তাদের ইসরায়েলি বর্বরতার শিকার হতে হয়। দখলদার বাহিনী তাদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে চায় পুন্যস্থান বায়তুল মোকাদ্দাস। এ জবরদখল কোনোদিন মেনে নিতে চায়নি পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা। তারা নিরস্ত্র। প্রতিরোধের কোনো হাতিয়ার নেই তাদের। অপরদিকে দখলদার বাহিনী অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র নিয়ে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তখন তারা শাহাদাতের তামান্না বুকে নিয়ে প্রতিদিনই কায়েম করে যায় ইন্তিফাদা। ট্যাংক, কামান ও বুলডোজারের আঘাতের জবাব দেয় মুষ্টি মুষ্টি পাথরের বৃষ্টি দিয়ে।

প্রতিটি ইন্তিফাদায় পাথরশিশুদের উচ্ছ্বসিত অংশগ্রহণ জাগিয়ে তুলে উত্তুঙ্গ আলোড়ন। ইন্তিফাদার ইলান পেয়ে অমিত তেজে জ্বলে ওঠে ওরা। দুঃসাহসিক মনোবল নিয়ে বুক টানটান করে দাঁড়ায় দখলদার বাহিনীর মারণাস্ত্রের সামনে। তখন ওদের চোখেমুখে ভয়ের কোনো চিহ্ন থাকে না; ভয়ের বদলে খেলা করে কৌতুক। এক হাতে গুলতি, আরেক হাতে পাথরের টুকরো। পাথরশিশুরা দখলদার বাহিনীর চোখে চোখ রেখে ছুঁড়ে প্রত্যাখ্যানের ঢিল। ইসরায়েলি বাহিনী ওদের এ পাথরকে অত্যন্ত ভয় পায়। পাথরের সামনে বেঁকে যায় তাদের বন্দুকের নল। একটি পাথরশিশুকে ধরার জন্য লেলিয়ে দেয় এক প্লাটুন সৈন্য। তারা গিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করে বন্দি করে পাথরশিশুটিকে। ওর চোখ বেঁধে দেয়, দুহাত পেছনে মুড়ে পরিয়ে দেয় হাতকড়া। বন্দি পাথরশিশুটি জানে ইসরায়েলি বর্বরতার কথা। তারপরও ওর চোখেমুখে খেলে যায় অন্যরকম দ্যুতি। বড়ো উজ্জীবিত মনে হয় ওকে। হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে থাকে। যেন একটি ফুটন্ত ফুল, একটু পরেই যে ঝরে যাবে, বিশ্ববাসীকে জানান দেয়—ঝরেই তো যাব! ঝরার আগে হাসিমুখে বলে যাই বিজয়ের কথা!

শেয়ার করুন