হেফাজতের একটি গভীর উপমা বা প্রতীকী (symbol) ব্যঞ্জনা আছে। এই ব্যঞ্জনার সুর ধরতে ব্যর্থ হলে হেফাজতের গভীরতা এবং ব্যাপ্তি বোঝা যাবে না। কেননা মুসলির তুরাসের নানাসময়ে, বিভিন্ন পর্যায়ে গোটা উম্মাহজুড়ে মোকাবিলার টুকরো টুকরো মেছাল ছড়িয়ে আছে। মুসলিম প্রতিবাদের এবং সক্রিয়তার জন্য দরকার হচ্ছে এই এবড়োখেবড়ো তীর দিয়ে চলবার এবং সেই জমিকে কর্ষণ করার জন্য একটি (একমাত্র নয়) পায়ে হাঁটা পথ। এটি স্থির নয় বরং ক্রিয়াশীল; এর মধ্যে নানা রদবদল হবে; আঞ্চলিক, দেশীয় এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে অনুসারীরা এর রূপকল্প (তরিকা) বদলে নেবে। এমনকি আনকোরা অভিজ্ঞতাকেও ঐতিহ্য বলে চালু করা যেতে পারে। ফলে হেফাজতে ইসলাম সেই এবড়োখেবড়ো অকর্ষিত জমিতে প্রস্ফুটিত একটি পদচ্ছাপ, প্রতীক বা উপমা—যেমন প্রতীক হিসেবে হাজির আছে তরিকায়ে মুহাম্মাদিয়া, ফকির বিদ্রোহ, পলাশী, ফরায়েজী এবং তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা।
প্রতিটা ঐতিহাসিক (শাপলার মতো) ঘটনার পেছনে ছোট হোক বড় হোক একটা বিপরীত বর্গ থাকে। প্রতীকী হলেও, সেই বর্গটা ছোট হলেও আলোচ্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। ছোট অথচ গুরুত্বপূর্ণ এই বিপরীত বর্গকে মনে না রাখলে হেফাজত উপমা হিসেবে বেঁচে থাকবে না। যেহেতু আমরা মনে করি প্রতিটা ঐতিহাসিক ঘটনা তার বিপরীত ঘটনার মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকে। আমরা শাহবাগকে সেই বিপরীত এবং পরাজিত নিশানা হিসেবে দেখতে চাইলে বন্ধুমহলের অনেকে গোস্বা করে। অথচ তারা জানে না, হেফাজত এবং শাহবাগের ঘটনা কেবল ঘটনাই নয়; এর সঙ্গে রয়েছে এর পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও চর্চার সংযোগ। শাহবাগের কোনো গভীর তাৎপর্য নেই বটে, তবে অবশ্যই এর মধ্যে গণবিরোধী, মুসলিমচৈতন্যবিরোধী এবং জুলুমতন্ত্রের ছাপ আছে। শাহবাগ তাই জুলুম ও বেঈমানীর নিশান (symbol)। আমরার চাইতে তাতে আমির-অন্বেষা বেশি, নসিহার পরিবর্তে শাহবাগে দেখি স্বার্থের কণ্ঠস্বর। অনাগত মুসলিম-ঐতিহ্যে হেফাজত একটি নয়া-প্রতীক; এতে নসিহা, ইনসাফ এবং ইসলাম গভীর ব্যঞ্জনায় হাজির হবে। হেফাজত কেবল হেফাজতের নয়; আপামর জনতার, গণমানুষের।
হেফাজতের রুহানী তাৎপর্য এখানেই নিহিত। হেফাজত নামে কোনো প্রতিষ্ঠান জিইয়ে রাখা অনুচিত। হেফাজতের নামে যত কিছুই হবে এখন, তেরোর রুহানিয়াত এবং মৌলিকত্ব থাকবে না। কাছাকাছি পৌঁছানোর একটা প্রচেষ্টা থাকবে কেবল। এবং যতবার কমিটি গঠিত হবে, হেফাজতের গায়ে ততটাই কলঙ্ক যুক্ত হবে। ‘হেফাজত’ নাম চাই না, হেফাজতের রুহানিয়াত চাই; এটাই আসল ও মৌলিক। কারণ, হেফাজতের উত্থান তার নাম দিয়ে হয়নি, তার রুহানিয়াত দিয়ে হয়েছে। তেরোর অনেক আগেই ‘হেফাজত’ নাম ছিল, কিন্তু রুহানিয়াত যুক্ত হয়েছে তেরোতে। সুতরাং, তেরোর হেফাজতকে তার নাম দিয়ে পাঠ না করে রুহানিয়াত দিয়ে পাঠ করুন। হাজী শরিয়তুল্লাহর এন্তেকালের পর ফরায়েজী আন্দোলনের সাংগঠনিক-সক্রিয়তা জারি থাকলেও তাতে বিজ্ঞজনদের আগ্রহ ছিল না। শরিয়তুল্লাহর চেতনা ও তৎপরতার বাইরে ফরায়েজী নামের অন্য যেকোনো তৎপরতা আমাদের কাছে গুরুত্ববহ নয়, তেমনই হেফাজতে ইসলাম। ইসলামের ইতিহাসে ফরায়েজী, বালাকোট এবং হেফাজত ধরনের তৎপরতার দ্যুতি কেবল একবারই বিচ্ছুরিত হয়েছে, তারপর কর্তাসত্তা হিসেবে শরীরী ওজুদ থেকে শায়েব হয়ে কেবল রুহানী নিশানায় (symbol) রূপান্তরিত হয়েছে। হেফাজতকে ১৩-এর প্রতিমূর্তিসহ দেখতে চাওয়ার যাবতীয় খায়েশ ইতিহাস ও বাস্তবতাবিরোধী।
৫ই মে নিপীড়িত হওয়ার ঘটনাকে আমি ‘হেফাজতে ইসলামের’ ব্যর্থতা হিসেবে পাঠ করি না। কেননা, ইতিহাসের এই কালপর্বে তাদের উত্থানটাই ছিল বিরাট এক সফলতা। প্রশ্ন হচ্ছে, কেউ কেউ তো ব্যর্থতা হিসেবে পাঠ করছে, এক্ষেত্রে দুটি নোক্তা তুলে ধরছি—
ক. যারা ব্যর্থতা হিসেবে পাঠ করছে, তাদের মধ্যে ক্ষমতা এবং পলিটিক্যাল অর্থই প্রধান; তারা মূলত হেফাজত দিয়ে একটা ক্ষমতাকেন্দ্রিক উত্থানের কল্পনা করছিল। হেফাজতের নেতৃত্বে থাকা অনেকের মধ্যেও এই চেতনা কাজ করেছে। এই স্বল্প-মেয়াদী অর্থের বিবেচনায় হেফাজতকে ব্যর্থ মনে করা নানা কারণে সমস্যাজনক। কেননা মডার্ন পলিটিক্যাল সাইন্সের ক্লাসিফিকেশন অনুসারেও হেফাজতে ইসলাম একটা ‘প্রেসার বা চাপ সৃষ্টিকারী’ গ্রুপ; তাদের উদ্দেশ্য ক্ষমতা না। তারা বরং নির্দিষ্ট কিছু স্বার্থের জন্যই রাজনৈতিক সংগ্রাম করবে। ইরান-বিপ্লবের ‘রাজনৈতিক রুহানিয়াত’ (ফুকোর ভাষা) দিয়েও হেফাজতকে পাঠ করা যাবে না। কারণ হেফাজতের রাজনৈতিক আবেদন অন্যদের মতো ছিল না। হেফাজতে ঈমানী লড়াই ছিল প্রধান প্রেরণা।
খ. হেফাজত ৫ই মে’তে ব্যর্থ না; বরং তার সফলতার জায়গা হচ্ছে, ‘সাংস্কৃতিক লড়াই’। এ দেশের সাংস্কৃতিক আধিপত্যের অভিমুখ শাহবাগ থেকে শাপলার দিকে ফিরিয়ে দিতে পেরেছে হেফাজতে ইসলাম; এর চেয়ে বড় কোনো অর্জন গত ৫০ বছরে এদেশের গণমানুদের কপালে জোটেনি। এ ছাড়াও বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতিতে হুজুরদের একটা অদৃশ্য পাওয়ার তৈয়ার হয়েছে। এই সফলতাকে জিইয়ে রাখাই ছিল ‘শাপলা-পরবর্তী’ হেফাজত নামের সংগঠনের প্রধান কাজ। কিন্তু সময়ে সময়ে তারা ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতা হেফাজতি পরিচয়ে সংগঠিত হওয়া লোকজনদের; হেফাজতের না। হেফাজত তার ৫ই মে’র পটভূমিতে সততই সফল।