চিরায়ত

কুরবানির স্মৃতির বেলা-অবেলা

প্রতি বছর কুরবানির সময়টা এলেই আলোগোছে আবছায়ার মতো কিছু স্মৃতি এসে তড়পাতে থাকে হৃদয়ের অলিন্দে।‌ মনে হয়ে একটা স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ ও আলোকিত সময় থেকে একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছি মিশমিশে কালো, ঘুটঘুটে অন্ধকারে দিকে। কখনো মনে হয়—ওই সময়টা ছিল বেবাক জোছনালোকিত রাতের মায়াবী ল্যাম্পপোস্টের সময়। মায়ায়-ছায়ায় আকাশের নীলের প্রতিবিম্ব। মনে হয়, আজকাল একটু একটু করে মিশে যাচ্ছি নিঃশেষে, নিঃশব্দে। একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছি নিঃসঙ্গতায়। ওই তো সেদিন—অস্পষ্ট আবছায়ার শৈশব, তখনও তো কুরবানি আসত, কী আশ্চর্য আলোড়নে—এ বাড়ি থেকে ও বাড়িতে, এই গরু থেকে সেই গরুতে, আব্বার নিজ হাতে মাথায় তুলে দেওয়া মাঝারি সাইজের গোশতের পাতিলে। ঈদ আসত, সত্যিই আসত—গরুর পাতলা পর্দা নিয়ে নারিকেলের শক্ত খোসায় (আমরা তাকে আরসি বলি) লাগিয়ে ঢোল-তবলা বানানোর অনন্ত অপেক্ষায়। ঈদ আসত—প্রিয় জিনিসটাকে শুধু আল্লাহর জন্য বিলিয়ে দেওয়ার প্রেরণায়। ঠাশ ঠাশ হাড্ডি কাটার শব্দে।

আমাদের ছিল নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার। গাঁয়ের অধিকাংশ পরিবারের চালচিত্র এমনই ছিল। এখন বিভিন্ন উপায়ে কিছুটা পরিবর্তন হলেও—তখন একা একটা গরু কুরবানি করার সামর্থ্য ও সাহস—কারোই ছিল না। আমার তো মনে হয়, আমাদের তখন কুরবানিই আবশ্যক ছিল না। তবুও আব্বা কুরবানি এলেই বহু কষ্টে সাত নামের খুব ছোট একটা গরুতে এক নামে শরিক হয়ে যেতেন। আমাদের জন্য এটাই ছিল ঢের; সীমাহীন আনন্দের। আব্বা জানতেন, কুরবানি না দিলে তার চার ছেলের এবছর আর ঈদ করা হবে না। কুরবানির গরুর জন্য ক্ষেতের আলে আলে দলবেধে ঘাস কাটতে যাওয়া, গরুর বুকেপিঠে হাত বুলিয়ে দেওয়া—তাদের এবছর আর হবে না। শুধু আমাদের জীবনে ঈদের আনন্দকে ছড়িয়ে দিতে আট-দশ হাজার টাকার অসহ্যকর একটা বোঝা আনন্দচিত্তে মাথায় তুলে নিতেন তিনি। আমাদের ঈদের আনন্দ আদৌও গোশত খাওয়ার মধ্যে ছিল না। আমাদের অবচেতন মনে আশ্চর্য শক্তিতে এসে ভর করত শিশু ইসমাইলের জবাইয়ের ইবরাহিমি চেতনা। (আলাইহিমুস সালাম) আমরা আসলে টেরই পেতাম না, কীভাবে মাত্র সপ্তাহ-চারেক দিনের ব্যবধানে একটি সামান্য প্রাণী ইসমাইলি প্রেমের নিদর্শন হিসেবে আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গেছে। একটু একটু আদরে-আহ্লাদে সামান্য একটা অবলা গরুকে কীভাবে যে আমরা এতটা ভালোবেসে ফেলতাম, সেটা আজও আমার কাছে অবোধগম্য। ঈদ যত ঘনিয়ে আসত, নিয়ম করে কুরবানির পশুর যত্ন-আত্মি আমাদের বেড়ে যেত। আমরা ঠিক বুঝতেই পারতাম না, যেমন গরু আমাদের গোয়ালেও দু-একটা আছে, যেটার কাছে যেতেও কখনো মন টানে না, ঠিক তেমন আরেকটি গরু—আমাদের হৃদয়ের সবটুকু কীভাবে দখল করে নিয়েছে। মনে হতো, এই প্রাণীটির সঙ্গে আমাদের হৃদয় আশ্চর্য শক্তিতে বাঁধা। আস্তে আস্তে মনে হতো, এটা আসলে তেমন কোনো গরু নয়, যা আমাদের বোটকা গন্ধের স্যাঁতস্যাঁতে গোয়ালেও দু-একটা আছে। এটা ঠিক সেই দুম্বা, যা আল্লাহ পাক যত্ন করে ইসমাইল আলাইহিস সালামের পরিবর্তে জবাই করার জন্য আসমান থেকে পাঠিয়েছেন। কুরবানির সময় ঘনিয়ে আসত আর ক্রমেই আমাদের ভেতরের অস্থিরতা বাড়তে থাকত। হৃদয় কেমন আঁকুপাঁকু করত। এভাবেই একদিন এক সকালে আমাদের দোরগোড়ায় এসে হাজির হতো ঈদ। মাঠে আর ঈদ তেমন জমত না। হাতে বেলুন বাঁশিও খুব একটা উঠত না। হৃদয়টা পড়ে থাকত গরুর কাছে। মনে হতো, যদি এই সময়টা খুব দীর্ঘ হতো। নামাজ থেকে কুরবানি—মাঝখানে দূরত্ব বেড়ে যেত হাজার বছরের। কিন্তু নামাজ পড়ে বাড়িতে যাওয়ার পরপরই একটা চকচকে ছুরি নিয়ে এসে হাজির হতেন কোনো হুজুর। আমরা ঠিক ইবরাহীম আলাইহিস সালামের মতো শক্ত থাকতে পারতাম না। পাশে দাঁড়িয়ে থাকতাম দুর্বল পায়ে। আমাদের চোখ টলমল করত। হৃদয় আকুলিবিকুলি করত। আশ্চর্য অস্থিরতা কাজ করত ভেতরজুড়ে। মনে হতো, ছুরিটা যেন ঠিক আমার গলায় চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। মূলত এর মধ্য দিয়ে আল্লাহর জন্য উৎসর্গের যেই আশ্চর্য চালচিত্র জীবন্ত হয়ে উঠত আমাদের সেই গ্রাম্য জীবনে—এটা আজকাল বিরল।

আজও ঈদ আসে, হয়তো ইসমাইলি প্রেমের দুম্বা কিংবা শুধু গোশত খাওয়ার প্রাণীতে; কিন্তু সেই ইসমাইলি চেতনার শিশুদের আর পাওয়া যায় না। তারা হারিয়ে গেছে আধুনিক প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারের দুর্ঘটনায়। আজকাল কুরবানি বেড়েছে। বেড়েছে মানুষের সঙ্গতি। কিন্তু হারিয়ে গেছে ইসমাইলি প্রেম; অজানায় মিশে গেছে গেছে ইসমাইলি চেতনা। আজকাল ঈদ আসে নতুন নতুন পোষাকে, জুতো আর সালামিতে। কিন্তু হৃদয়ে আর ঈদ আসে না। আমাদের সামান্য গরুগুলো আর হয়ে ওঠে না ইসমাইলি প্রেমের নিদর্শন বেহেশতি দুম্বা। এদের আর কেউ ভালোবাসার হাত বুলিয়ে দেয় না শিশুরা। ক্ষেতের আলপথ ঘুরে কেউ ঘাসও এনে দেয় না। এসব আজকাল আদিখ্যেতা। কেনা গরু গৃহস্থের গোয়ালে পাঠিয়ে দিয়ে আনা হয় ঈদের দিন সকালে। বাড়তি ঝামেলা কে করে শুধু শুধু। যেখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে গোশত খাওয়া, ফ্রিজ ভরে রাখা, সেখানে ইসমাইলি প্রেম আদিখ্যেতা। 

ক’বছর ধরে দেখছি, আমাদের এলাকার ছেলেরা ঈদের দিন আশেপাশের এলাকার ছেলেদের বিরুদ্ধে ক্রিকেট খেলা রাখে। বিভিন্ন মাধ্যমে হাতে আসা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দিয়ে চলে খেলার নামে অবাধ জুয়া। দিনভর চলে এসব। কিংবা এদিন চলে অবাধ ঘোরাঘুরি। সকালে ঈদের নামাজের পর সামান্য খাওয়া-দাওয়ার পর আর তাদের হদিস মেলে না। বাধ্য হয়ে বাড়ির বড়রা সারাদিন নিজেরাই গোশত কেটেকুটে শেষ করে। এইসব কিশোররা যখন বাড়ি ফিরে, ততক্ষণে রক্তের বিশ্রী বোটকা গন্ধ ছাড়া এদের জন্য আর কিছুই থাকে না। তারা এসে নাক সিঁটকায়। এখানে সেখানে গরু জবাইয়ের সমালোচনা করে। নীতিকথা বলে। ইসমাইলি প্রেম বুকে ধারণ করার মতো সময় আর তাদের কই! আমি প্রায়শই আব্বা-আম্মাকে বলি, এসব শরিকানা কুরবান বাদ দাও। এসব আদতে কোনো কুরবানি হয় না। সুদখোর, ঘুসখোর, জুয়াড়ি, বদনিয়তি, লোকদেখানো ব্যক্তির টাকা—আরও কত অসঙ্গতি এইসব কুরবানির ফাঁকে ফাঁকে। সাতজনের কজনের টাকার আর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায়! আমার চোখেদেখা একশো কুরবানির নব্বইটাই হয় না। তবুও গ্রামের মানুষ এসব বাঁধা ছক থেকে বের হতে পারে না। আমি প্রায়শই বলি, আমরা তো আলাদা ছাগল কুরবানি দিলেও পারি, কিন্তু তারা রাজি হন না। এর বহুবিধ কারণ। সমাজের গটঁবাধা নিয়মকে উপেক্ষা করার সাহস তাদের নেই। তাছাড়া গরুর গোশতের ঈদে যেই ঐতিহাসিক এলাহি কাণ্ড, সেই মায়াকে তারা ছিন্ন করতে পারে না। কিন্তু এই যে আমাদের কিশোরদের চিন্তাগত পরিবর্তন, এর বাঁকগুলো নিয়ে আমাদের ভাবা উচিত। আমাদের সেই সময় থেকে এই সময়—কতটুকুই বা আর ব্যবধান! কুরবানির হওয়া না হওয়া—এই চিন্তাগত পরিবর্তন যদিও সেই এই যুগের মধ্যে খুব একটা পরিবর্তন নেই, কিন্তু কিশোরদের ইসমাইলি প্রেম ও চেতনা হারানোর যেই অধঃপতন, এটা তো বাস্তব। তরুণ আলেমদের এগুলো নিয়ে ভাবা উচিত। এই সমাজকে, সমাজের আপামর মানুষকে যতদিন কুরবানির ইবরাহীম ও ইসমাইল আলাইহিমুস সালামের প্রেম ও চেতনার ওপর না আনতে পারব, এসব কুরবানি নিছক গোশত খাওয়ার গল্প। আদতে আমাদের সমাজে ইসলামকে ধারণ করার মতো কিছুই থাকবে না। আজকের কিশোর আগামী দিনের সমাজ-সংস্কৃতির ধারক। এদের যদি কুরবানির ইসমাইলি প্রেম ও চেতনার ওপর তুলে আনতে না পারি, তাহলে এই অধঃপতনের গল্প আরো দীর্ঘ হবে। গ্রাম্য হালাল-হারামের সংমিশ্রণের কুরবানিতে যদি আমরা পরিবর্তন আনতে না পারি, কুরবানি মানে গোশত খাওয়ার গল্পই সমাজে প্রতিষ্ঠা হবে। আল্লাহ পাক আমাদের উম্মাহ নিয়ে ফিকির করার তৌফিক দান করুন।

শেয়ার করুন