১.
ফিলিস্তিনের শিশুরা কি পাথর? নাহ, তারা আসলে পাথর না, রক্ত-মাংসে গড়া জীবন্ত মানুষ। তবুও আমাদের চোখে তারা পাথরশিশু। কেননা, ওরা এতিম। স্বজনহারা। স্নেহহারা। অভিভাবকত্ব-বঞ্চিত। ওদের মাথায় অনেক মানুষের রক্তের ঋণ। এ ঋণ শোধ করার দায় ওদের নিত্য তাড়িয়ে বেড়ায়—শান্তিতে একটু ঘুমুতেও দেয় না। স্বস্তিতে একটু নিঃশ্বাসও ফেলতে দেয় না। রাত গভীর হলে ওদের ঘুম গভীর হয় না। নেমে আসে নীরব রাতের নির্জন প্রহরে তপ্ত অশ্রুধারা। বয়ে যায় কপোল বেয়ে। ভিজে যায় বাবা-মায়ের স্মৃতি-বিজড়িত বালিশ। সকালে বেরিয়ে যায় স্কুলে। কথা হয় সহপাঠী বন্ধুদের সাথে। শব্দের ভেতরে ফুটে ওঠে কান্না। চোখে ছলছল করে ওঠে ‘অবাধ্য’ অশ্রুকণা।
২.
পাঠে ওদের মন বসে না। বাসায় ফিরতেও ইচ্ছে করে না। হাসির ভেতরেও হাসতে পারে না। কান্না দেখলে অবাক তাকিয়ে থাকে। পাথরের মতো নিশ্চল ভঙ্গিতে। অনুভূতিতে ঝড় বয়ে যায়। কিন্তু প্রকাশ করতে পারে না। বাবার রক্তাক্ত লাশের ছবিটা সামনে ভাসতে থাকে। মায়ের শেষ চেষ্টার চিত্রটা মনের ভেতরে তুফান বইয়ে দিতে থাকে। পেছনে এসে কেউ যখন কাঁধে হাত রাখে, পাথরদৃষ্টি নিয়ে তাকায়। কথা বলতে ভুলে যায়। কেনো ওরা এমন?
৩.
কোমলমতি শিশুরা আর কোমল থাকতে পারে না। কলমের কালিতে ঝরে না সকালবেলার ত্বীন-যাইতুনের মিষ্টি ছায়ার কথা। বিকেলবেলার কুবব্বাতুস সাখরার ছায়ার মিষ্টি বিবরণের কথা। আলআকসার সকাল-সন্ধ্যার রুহানি আবহের বর্ণনাও ঝরে না ওদের কলমে। ওদের কলম হয়ে যায় বারুদের ঠিকানা। ওদের কলমের কালি হয়ে যায় বুলেটের আঘাতের চেয়ে ভীতিসঞ্চারক। শহীদের বাড়ির দেয়ালে লিখে চলে ওরা সেই কলমে প্রতিশোধের শানিত শব্দগাথা।
৪.
কান পেতে থাকে ওরা, কখন আসে কী ঘোষণা। মিছিলের ঘোষণা কানে ওদের মধু ঢালে। সকালের মতো বিকেলেও। দিনের মতো রাতেও। বেরিয়ে যায় স্কুলব্যাগটায় কয়েকমুঠো পাথর ভরে। বাইরের পকেটটায় গোলাইল ভরে। বের হওয়ার আগে এতিম বাড়ির দিকে তাকিয়ে সংকল্পের দৃঢ়তায় একটু শান দিয়ে যায়। ফিরলে আবার দেখা হবে—নীরব ভাষায় তা-ও বলে যায়।
৫.
মাঝে মাঝে ওরা বন্ধু হারায়। সহপাঠী হারায়—বাবা হারানোর পর। মা হারানোর পর। ভাই হারানোর পর। ওরা শুধু হারাতেই থাকে। হারানোর মিছিলের যেনো আর শেষমাথা নেই।
হ্যাঁ, এক সময় নিজের জীবনটা হারাতেও ওরা পাথর হয়ে যায়।
হাসার সময় হাসে না।
কান্নার সময় কাঁধে না।
কেউ প্রিয়তা ঝরিয়ে ডাকলে পেছনে ফিরে তাকাতেও ভুলে যায়।
শুধু একটি মুহূর্তেই ওরা সচকিত হয়ে ওঠে। ইহুদি সৈন্যদের সামনে। ওদের অস্ত্রের সামনে। ওদের ট্যাংকের সামনে। ভয়হীন দৃপ্ত পায়ে যায় এগিয়ে। যেনো দুমড়ে মুচড়ে সব শেষ করে দেবে।
হে ফিলিস্তিনের পাথরশিশুরা,
তোমাদের চিত্র আমি আসলে আঁকতে পারবো না। আমার তুলিতে কালি নেই। আমার ভাষায় শক্তি নেই। আমার বোধে চেতনা নেই। আমার রক্তে উষ্ণতা নেই। আমার বিবেকে দোলন-শক্তি নেই। তোমরাই তোমাদের ছবি আঁকো। এ ছবিই আসল ছবি। তোমাদের মনের নীরব গহিনে ঢুকতে পারার ক্ষমতা আমার নেই। ক্ষমা করো হে বন্ধুরা। তবে একটা কথা শুনে রাখো, আমার বুকে লালন করে চলেছি তোমাদের জন্যে যে ভালোবাসা, তা বুকটা খুলে না দেখালে তোমরা বিশ্বাস করবে না—কতো গভীর সে ভালোবাসা—কী অতলান্ত।