রাসূলের যমানা থেকেই সাহাবায়ে কেরাম ইসলাম নিয়ে পৃথিবীর দিগদিগন্তে ছড়িয়ে পড়েছেন। সেই ধারাবাহিকতায় বাদ পড়েনি আমাদের এই পলিধৌত ভারতবর্ষও। এখানেও আরবদের অবাধ যাতায়াত ছিল। প্রথমে ব্যবসা পরে ছুটে এসেছেন ইসলাম প্রচারের জন্য । সেই সুবাধে এই অঞ্চলের অনেকে ইসলাম গ্রহণ করে আরবে চলে গেছেন রাসুলের সোহবত পেতে। এমনই একজন সাহাবীর নাম চেরামল পেরুমল। মুসলমান হওয়ার পর নাম রাখা হয় তাজুদ্দীন। তবে ইতিহাসে তার তাজুদ্দীন নাম থেকে চেরামল পেরুমল নামটাই বেশি সমাদৃত।
বর্তমান ভারতের দক্ষিণের কেরালা অঞ্চলে মালাবরের নিকটে চেরারাজ্য ছিল। সেই রাজ্যের রাজাদের উপাধি ছিল চেরামান পেরুমল। ৬০০ সালে সেই অঞ্চলের রাজা ছিল রবিবার্মা। পুরো নাম চেরামান পেরুমল রবিবার্মা। রবিবার্মা একদিন নিঁখোজ হলেন। কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বহুদিন পর হাদিস ও ইতিহাসের সূত্র ধরে জানা যায় এই রবিবার্মা চেরামান পেরুমলই হলেন ভারতের প্রথম মুসলমান ও সাহাবী। সেই রাজার ডায়রি লেখার অভ্যেস ছিল। ডায়রিতে তিনি লেখেন-
‘একদিন আমি ও আমার সহধর্মিণী ছাদে বসে জোৎস্না বিলাস করছিলাম। ভিজছিলাম চাঁদের আলোয় । ওই দিন চাঁদও তার পূর্ণ আলোর পসরা সাজিয়ে রাতকে করে তুলেছিল বেশ উপভোগ্য ও মুগ্ধকর। হঠাৎ দেখলাম চাঁদ দ্বিখণ্ডিত। দুই দিকে দুই টুকরো। এই কাহিনী আমার স্ত্রী আমার পাশে বসেই দেখেছে। আমি আমার সভাসদবর্গকে ডেকে দেখালাম। সবাই বিস্ময়ে থ বনে গেলো। এর কিছুদিন পরই কেরালার মালাবর অঞ্চলে আরব্যবণিকদের যাতায়াত শুরু হয়। তাদের মাধ্যমে ভারতের অনেকের আরব নবীর চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার কাহিনী জানাজানি হয়। শুনতে পাই আমিও।’
জানা যায় তিনি আরব থেকে আগত মুসলমানদের সাথে দেখা করেন। তাদের সাথে পরামর্শ করেন। তিনি আগ্রহ প্রকাশ করেন এই অলৌকিক ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে তিনি দেখবেন। সেই আগ্রহ বুকে চেপে একদিন মক্কায় উপস্থিত হন। সময়টা তখন ৬১৯/২০ সাল হবে। শাওয়াল মাস। রাসূলের সাথে সাক্ষাৎ করেন। মুসলমান হওয়ার অভিলাষ প্রকাশ করেন। আবু বকরসহ মান্যবর অনেক সাহাবীই সেই মজলিসে উপস্থিত ছিলেন। রাসুলুল্লাহ তাকে কালিমা পড়ালেন। তিনি মুসলমান হয়ে গেলেন। নাম পরিবর্তন করে রাখলেন তাজুদ্দীন। সেই সময় তাজুদ্দীন রাসুলুল্লাহকে তৎসময়ের ভারতের কোন এক রাজার বিখ্যাত আচার হাদিয়া দেন। এই সম্পর্কে মুসতাদরেক আলহাকিমের মধ্যে একটি হাদিসও বর্ণিত হয়েছে। হাদিসটি- হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘ভারতীয় রাজা নবীজী (সা.) কে এক বয়াম আচার হাদিয়া দেন, যার মধ্যে ছোট ছোট আদার টুকরা ছিল। নবীজী (সা.) সেই টুকরাগুলো তার সাহাবীদের ভাগ করে দিলেন। আমাকেও একটু দিয়েছিলেন। মুসতাদরেক, হাদিস নং : ৭১৯০
হযরত তাজুদ্দীন চরামান পেরুমল রাসুলুল্লাহ এর সোহবতে ১৭ দিন ছিলেন। রাসুলুল্লাহ তার সাথে সাহাবী মালিক বিন দিনার (রা.) এর বোন রাজিয়া (রা.) কে বিয়ে দিয়ে দেন। দীনি দাওয়াতের জন্য তিনি আর আরবে থাকতে চাচ্ছিলেন না। তাই এই অল্প সময়ই সোহবত গ্রহণ করে ভারতে ফিরে আসার অনুমতি কামনা করেন। রাসুলুল্লাহ তাকে অনুমতি ও দোয়া দিয়ে দেন। অতপর তিনি তার স্ত্রী রাজিয়া (রা.) ও তার স্ত্রীর ভাই মালিক ইবনে দিনার (রা.) কে নিয়ে ভারতের দিকে যাত্রা করেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! তিনি ওমান সাগর হয়ে ভারত ফিরতে ছিলেন। ওমানেই মৃত্যুবরণ করেন। অতপর তাকে সেখানেই সমাধিস্থ করা হয়। মৃত্যুর আগে তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী সাহাবী মালিক দিনার রা. ভারতে এসে চেরামান রাজার জন্মভূমি কেরালার মেথেলায় ভারতের একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। ইতিহাস বলছে এটিই ভারতের মাটিতে প্রথম জামে মসজিদ। মসজিদের নাম রাখেন ‘চেরামান জুমা মসজিদ’। যা বহুকাল পর এখনো ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় সংরক্ষিত রয়েছে।
ধারণা করা হয়, এই মসজিদ রাসুুলুল্লাহ (সা.) এর জীবদ্দশায় ৬২৯ সালে নির্মিত। অর্থাৎ মুহাম্মাদ বিন কাশিমের ভারত আগমনের প্রায় ৮০ বছর আগের ঘটনা এটি।
লেখক : সম্পাদক- ত্রৈমাসিক উদয়ন