চিরায়ত

ঈদ ও শৈশবের ঈদ

‘ঈদ’ হাসিখুশী মিশ্রিত একটি মধুর শব্দ। অন্নহীন শিশু, বস্ত্রহারা মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে আনন্দমুখর করে তোলার নামই ‘ঈদ।’ নিজের সুখ অন্যের তরে বিলিয়ে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরী করার নামই ‘ঈদ।’ এতিম, অসহায় মানুষের হৃদে আনন্দ অনুভাবিত করানোই ‘ঈদ।’ ঈদের দিন রসঘন ও মধুময় তখনই হবে, যখন সবাই এইদিনে সংযত আচারে আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠবে। এইদিন উপলক্ষে পথশিশু, টোকাই, ফেরিওয়ালা, অসুস্থ, প্রতিবন্ধীরাও মনেপ্রাণে চায় একটু আনন্দ উপভোগ করতে। সুখদুখমাখা গল্পগুলো একে-অপরের মাঝে ভাগাভাগি করতে। সুন্দর একটা চকচকে ঝলমলে জামা পরে আত্মীয়স্বজনদের সম্মুখে দাঁড়াতে। এই দাঁড়ানোটা যদি আমরা সবাই মিলেমিশে করতে পারি; তবেই আমাদের এই ঈদ ‘মুবারক’ হবে এবং অনাবিল সুখ শান্তি নিয়ে বারবার আমাদের মাঝে ফিরে আসবে—। আমরা জানি ঈদ মানেই অনাবিল আনন্দ উচ্ছ্বাসের ঝর্ণাধারার উৎস, ভালোবাসা আর উৎসবের আমেজের দৃশ্য। ঈদ আমাদের প্রাত্যিক জীবনে ও সামাজিক বন্ধনকে উজ্জীবিত করে তুলে নানানভাবে।

ঈদ উদযাপনে প্রতিটি জাতির পথ, মত ও পদ্ধতিতে রয়েছে ভিন্নতা। আমরা মুসলিম জাতি। সৃংঙ্খলাবদ্ধ জাতি। আমাদের সবকিছু পরিপাটির ভেতর সীমাবদ্ধ। এলোমেলো, অগোছালো, কোনো কিছুই আমরা আমলে নিই না। রুচিশীল জাতির কাজও রুচিসম্মত ও স্বচ্ছন্দে মত হওয়াটাই স্বাভাবিক। সে হিসেবে আমাদেরও কিছু নিয়ম, পদ্ধতি অনুসৃত। নিয়মবহির্ভূত কাজ মুসলিম জাতির জন্য কখনও শোভা পায় না। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম জাতির জন্য দুটি খুশির দিন নির্ধারণ করে উৎসবের প্রাঙ্গণ দেখিয়ে দিয়েছেন। এই দিনগুলোতে আমরা খুশিতে ডগমগ করব। আনন্দে উচ্ছ্বসিত হব। নতুন সাজে সজ্জিত হয়ে একে-অপরের মাঝে ভালোবাসা বিলিয়ে দেব।

শৈশবের ঈদ মানে ভিন্ন ও অন্য স্বাদের হাওয়া। ঈদের আগের দিন জড়ো হয়ে একসঙ্গে বাড়ির অদূরে ধানি জমিনের পাশে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখে হৈ-হুল্লোড় করে চাঁদ উঠেছে চাঁদ উঠেছে বলে চেঁচামেচি করা। ঈদ উপলক্ষ্যে গোসল করা আমাদের জন্য ছিল অনিবার্য। গোসল না করলে ঈদই হবে না, মনোভাব ছিল আমাদের এরকমই। সঙ্গে এই ধারণা ছিল; ভোরবেলাতেই সবার আগেভাগে গোসল করতে হবে। তারপর বাবার কিনে দেওয়া শার্ট, জামা-লুঙ্গি পরে ঈদগাহের দিকে দৌড়। আমাদের আব্বা ছিলেন দিনমজুর। আমাদের ঈদের উজ্জ্বল কোনো স্মৃতি নেই, আছে ঝিমিয়ে পড়া কিছু খুচরালাপ। মানুষের বাড়িতে কর্মচারী হিসেবে থেকে কাজকাম করতেন আমাদের বাবা। মাস শেষে যা মাইনে পেতেন, তা দিয়ে চলত সংসার। ঈদ উপলক্ষ্যে বাড়িতে আসার সময় নিয়ে আসতেন আমাদের ভাইবোনের জন্য কাপড়চোপড়। তাও লুঙ্গি থাকত সস্তা দামের। কাপড়গুলো থাকত বাজারের গলির মোড় থেকে কেনা। আমরা বলতাম টেট্রনের কাপড়। যা পড়লে গরমের দিন গায়ে জ্বলেপুড়ে। আমাদের ধনী চাচাতো ভাইয়েরা এ-সব নিয়ে রংতামাশা করত। বলত, পলিস্টার, টেট্রটন ইত্যাদি। আমরাও এগুলো হাসিমুখে মনে নিতাম। অভাবের কারণেই কালেভদ্রে আমাদের কপালে কাপড় জুটত। নতুবা এইসব ঈদ উপলক্ষ্যে যা পাওয়া যেত!

আমি শৈশবে শীতের দিনে ঈদ পেয়েছি। বাড়ি ও বাড়ির আশপাশ তখন থাকত হরেকরকমের শাকসবজির বাগান। বাড়ির দহলিজ, বনজঙ্গল সবকিছু থাকত শুকনো, চকচকে, ঝলমলে। আমাদের এলাকার ঘরদোর তখন ছিল বাঁশবেতের। বেশিরভাগ ঘরই ছিল শনের। শনের ওপর থাকত কদু, লাউ-কুমড়ার ঝাড়। সেই কুমড়া, কদু দিয়ে ঈদের সময় পিঠাপুলির খাওয়ার জমজমাট আয়োজন হত। এখন তো পিঠাপুলির পরিবর্তে সন্দেশের সমাহার চোখে পড়ে। কুরবানির ঈদ হলে গরুর গোশত দিয়ে পিঠাপুলির স্বাদ বেড়ে যেত। দাদাকে দেখতাম, ডালির মধ্যে পিঠে টুকরো টুকরো করে দিয়ে তারপর মজা করে খেতেন। তবে বেশিরভাগ সময় কদু দিয়ে খেতেন। শৈশবের ঈদের আরেকটি আয়োজন ছিল আমাদের জন্য মোহনীয়; ঈদের দুদিন আগ থেকেই বাঁশপাতা, ডুঙি ইত্যাদি জমা করতাম ঈদের দিনে গোসল করে আগুন পোহানোর জন্য। আগুন পোহালে কাপড় গন্ধ হবে—সেটা আমাদের জন্য মুখ্য ছিল না। কুরবানির ঈদে হাঁটে যেতাম গরু দেখার জন্য। কাছে যেতাম না গরুর, লাথি মারার ভয়ে। এভাবেই শৈশবের ঈদ উদযাপন করতাম।

সম্পাদক, সরোবর

শেয়ার করুন