চিরায়ত

আমার গুরু থাকে মিরপুর দশ নম্বরে

পুরোনো বই কিনে বেশি পড়া হয়েছে মিরপুর ৬ নম্বর মাদরাসায় পড়াকালীন। চার বছর পড়েছি ওই মাদরাসায়, হেদায়াতুন্নাহু থেকে জালালাইন ক্লাস। জালালাইনের পরের বছরও ওখানে ভর্তি হতে গিয়েছিলাম মিশকাতের জন্য। কিন্তু মাদরাসা কর্তৃপক্ষ ভর্তি করেনি। জালালাইনে থাকতে একটা ছাত্র আন্দোলনে নেতাগোছের মতো ছিলাম। মাদরাসার কমিটি থেকে সে আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া এলাকার ওয়ার্ড কমিশন পর্যন্ত গড়ায়। ঘটনা অতদূর গড়ালে মাদরাসার হুজুররা কি আর অমন ছাত্র রাখবে মাদরাসায়?

যাকগে সে কথা, ধান ভানতে শিবের গীতের দরকার নাই! আসেন, ধান ভানি… তো, ৬ নম্বর মাদরাসায় থাকতে প্রচুর বই পড়তাম। বিশেষত সেবা প্রকাশনীর বই। এছাড়া ছিল বিভিন্ন দৈনিকের ঈদসংখ্যা। একেকটা ঈদসংখ্যায় কমসে কম গোটা দশেক উপন্যাস থাকত, আরও বিশ-ত্রিশটা গল্প। হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, হাসানাত আবদুল হাইসহ তখনকার প্রায় সব ঔপন্যাসিকের উপন্যাস থাকত ঈদসংখ্যাগুলোতে। নানা স্বাদের একেকটা উপন্যাস। কখনো কলকাতার দেশ বা সানন্দার ঈদসংখ্যাও হাতে আসতো। উপন্যাসগুলোতে অবশ্য প্রাপ্তবয়স্ক বাতচিত থাকত, ওই বয়সে মন্দ লাগত না। শীর্ষেন্দু, সুনীল, সমরেশের সঙ্গে আমার আগেই পরিচয় ছিল; বাড়িতে বড় বোনেরা হাই স্কুলের লাইব্রেরি থেকে প্রচুর বই এনে পড়ত। হেফজখানা থেকেই তাদের বইয়ের সঙ্গে তাই আমার দহরম মহরম হতে দেরি হয়নি।

হরেক রকম বই আর ঈদসংখ্যাগুলো আমরা নতুন কিনতাম না, পুরোনো কিনতাম। মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বরের পাশে সিটি কর্পোরেশনের একটা টিনশেড মার্কেট ছিল। সেই মার্কেটের সামনে পুরোনো বই নিয়ে দু-তিনটে টং দোকান ছিল। তাদের কাছে সবই পুরোনো বই। ৩০০ টাকার একটা ঈদসংখ্যা আমরা কিনতাম ৪০ বা ৫০ টাকায়। সেবা প্রকাশনীর মাসুদ রানা, অনুবাদ, ওয়েস্টার্ন এগুলোর দাম ছিল ২০ টাকা। পড়ে ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থাও ছিল। ২০ টাকার বই পড়ে ফেরত দিলে আবার ১০ টাকা রিটার্ন দিত। ভালো ব্যবস্থা!

ওই সময়টাতে গোগ্রাসে গিলেছি যাচ্ছেতাই। যা পড়তে ইচ্ছা করত, তা-ই পড়তে দ্বিধা করতাম না। ক্লাসের পড়ার ফাঁকে, রাতে বা দিনের আড্ডার সময়, ঘুমানোর সময়, বাইরে বেড়ানোর সময় আমি নেশাগ্রস্তের মতো পড়তাম। এটাই আমার একমাত্র বিনোদন ছিল। আমি পণ করে রেখেছিলাম, যতক্ষণ জেগে থাকি পাঁচটা মিনিট আমি বই ছাড়া থাকব না। খোদার শোকর, তখন স্মার্টফোন ছিল না। তাই বলে ক্লাসের পড়াশোনায় কিন্তু ল্যাবন্ডিশ ছিলাম না, দুই-তিনে রোল থাকত। সৃজনশীল তরিকায় পরীক্ষা দিতাম আমি!

বই কেবল আমি একা পড়তাম না। আরও কয়েকজন ছিল। আমার সঙ্গে যোজনা মিলিয়ে পড়ত পাবনার আবদুল্লাহিল মারুফ। আমরা ডাকতাম ‘হিল মারুফ’ বলে। জিরাফের মতো লম্বা ছিল। পড়াশোনায়ও ভালো। প্রায়ই ওর সঙ্গে আমার সিরিয়াল নিয়ে টানটান উত্তেজনা তৈরি হতো, পরীক্ষার ফলাফলে। বই পড়াতেও দুজন বদলা-বদলি করে পড়তাম। কখনো কোনো একটি বই কিনতে আমি দিতাম ১০ টাকা, ও দিত ১০। ঈদসংখ্যা কিনতে আমি দিতাম ৩০, ও দিত ২০। কিছুটা কিপ্টা ছিল ও, ১০ টাকার উদারতা দেখাতাম আমি। এমনিতে বন্ধুবাৎসল্যে আমি বরাবরেই উদার!

আমার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল রোমাঞ্চ উপন্যাস, থ্রিলার উপন্যাস, হিস্ট্রিক্যাল থ্রিলার, ওয়েস্টার্ন, যদিও তিন গোয়েন্দা থেকে বয়স ততদিনে লায়েক হয়ে উঠেছে। আমার জীবনে ‘মাসুদ রানা’র স্বর্ণযুগ বলা যায় মিরপুরকে। তবে সেবা প্রকাশনীর অনুবাদ উপন্যাসগুলো তখন আমার মনোজগতে এক নতুন পরিবর্তন নিয়ে আসে। সেগুলোর মধ্যে হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাসগুলো আমাকে অভিভূত করে তোলে। নবীদের কাহিনি নিয়ে এত সাবলীলভাবে উপন্যাস লেখা যায়? ইসলামি বীরদের জীবন নিয়ে এত সুন্দর ফিকশন তৈরি করা যায়? ‘জাস্ট ওয়াও’ হয়ে গেলাম।

আর সেবার অনুবাদকদের তারিফ না করে পারছি না, এমন জলজ্যান্ত অনুবাদ তারা করতেন, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকতাম। একজন পাঠক যদি কোনো বই পড়ে মুগ্ধতায় ভেবে ভেবে তিনটা দিন কাটিয়ে দেয় আর মনের মধ্যে চিন্তার নতুন একটা জগত তৈরি হয়, অনুবাদক জন্ম তারই সার্থক হওয়া উচিত। মুন অভ ইজরাইল, দ্য ব্রেদরেন, ক্লিউপেট্রা এবং অন্যান্য বইগুলো আমার সেই জায়গা তৈরি করে দিয়েছিল। মূলত হেনরি হ্যাগার্ডই আমাকে ঐতিহাসিক ফিকশন ও গল্পভাষ্য লিখতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।

সম্প্রতি সেবা প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা এবং বাংলাদেশের কিংবদন্তি লেখক ও প্রকাশক কাজী আনোয়ার হোসেন পরলোকগমন করেছেন। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জন্য মানসম্পন্ন পঠনসামগ্রীর এক অতুল্য আধার তিনি রেখে গেছেন। একটি জেনারেশনই তিনি তৈরি করেছেন। তার আত্মার মাগফেরাত

কামনা করি।

আমার আজকের ইতিহাস-অনুসন্ধিৎসা, সবার চেয়ে ভিন্ন কিছু লেখার অনুপ্রেরণা, সব চেয়ে ভালো লেখার তাড়না—এর অনুঘটক ছিল মিরপুরের সেই পুরোনো বইয়ের দোকানগুলো। সেখানে সেই সস্তা মূল্যে বইগুলো যদি কিনতে না পারতাম তাহলে হয়তো পরিচয় হতো না আমার অন্তরঙ্গ বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে। আমার হৃদয়ের অনেক জ্ঞানকপাট রয়ে যেত হিমশীতল

অতলে বন্ধ। জ্ঞানের সরু সাঁকো পেরোতে পেরোতে কোনোদিন জানতেই পারতাম না। অদ্ভুত সুন্দর এই বেঁচে থাকা।

(পূর্বপ্রকাশ : চিরায়ত ২য় সংখ্যা)
শেয়ার করুন